লাশের পাশে শুয়ে থাকলাম

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: কারিমা আক্তার, অষ্টম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), হাজী নূরউদ্দীন আহম্মদ উচ্চবিদ্যালয়, রূপসী, নারায়ণগঞ্জ

বর্ণনাকারী: আব্দুল রাজ্জাক, মাসাব, রূপসী, নারায়ণগঞ্জ

সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: মেয়ে–বাবা

চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হলো
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ। সকাল আটটা। সৈয়দপুর। ভাবীকে নিয়ে আমার ভাই যাবেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রাস্তাঘাট পুরোপুরি অনিরাপদ। গাড়িঘোড়া বন্ধ। কিন্তু ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি যেতেই হবে, জরুরি কাজ। তাঁদের সঙ্গে আমিও রওনা হলাম। যেতে যেতে হঠাৎ কানে এল গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণ পর আবার চার-পাঁচটি গুলি ফুটল।

সবাই বোঝার চেষ্টা করছিলাম, গুলির আওয়াজ কোন দিক থেকে আসছে। এমন সময় তৎকালীন ইপিআরের (বর্তমান বিডিআর) পাঁচ-ছয়জন সদস্য দৌড়ে সৈয়দপুর শহরের দিকে যাচ্ছিলেন। পেছন পেছন হাজারো মানুষের ঢল। হাতে দা, কুড়াল, লাঠি, তীর, ধনুক, বন্দুক, এমনকি মুগুর পর্যন্ত।

তখন আমি সবে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছি। মনে ভীষণ ক্ষোভ, পশ্চিম পাকিস্তানিদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে। তাই যোগ দিলাম মানুষের দলে, হাতিয়ার হিসেবে নিলাম একটি মুগুর।

আরও পড়ুন

আমাদের বাড়ি থেকে সৈয়দপুরের দূরত্ব ৬ মাইল। আমরা হেঁটে কাছাকাছি চলে গেলাম, শহর থেকে মাত্র এক মাইল দূরে। শহর দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু সে সময় ছুটে যাওয়া মানুষ দেখে বিস্ময়ের শেষ রইল না! ওই বয়সে একসঙ্গে এত লোক দেখিনি। মনে তখন একটিই ভাবনা, কখন যুদ্ধ শুরু হবে। আমাদের সামনেই ইপিআর সদস্যরা পজিশন নিলেন।

সৈয়দপুর সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখি। সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানায় বেশির ভাগ কর্মী ছিল বিহারি। কারখানায় বাঙালিদের কোনো ঠাঁই ছিল না। তাই স্থানীয় লোকের ক্ষোভ ছিল ভীষণ। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যাঁরা সৈয়দপুর আসতেন, তাঁদের সঙ্গে বিহারিরা খুব খারাপ আচরণ ও জুলুম করত। তাই এলাকাবাসীর ক্ষোভ দ্বিগুণ হয়ে উঠেছিল।

এলাকার প্রভাবশালী মাহতাব বেগ সবার সামনে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আমরা তখন বুঝতে পারিনি, সেখানে পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন দালান ও ছাদে অস্ত্র হাতে ওত পেতে ছিল। মাহতাব বেগ ব্যাপারটা টের পেয়ে হাতের ইশারায় সবাইকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বললেন। আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম।

আরও পড়ুন

বেগ সাহেব তখন গুলি করতে শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইপিআর সদস্যরাও গুলি শুরু করলেন রাইফেল দিয়ে। চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হলো। শহরে আগুনের কুণ্ডলী। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন সৈয়দপুর শহরে প্রবেশ করতে শুরু করল।

তখন হঠাৎ একটি হেলিকপ্টারের আওয়াজ পেলাম। কিন্তু লোকজনের জন্য হেলিকপ্টারটা কোথাও নামতে পারছিল না। তিন–চারটি চক্কর দেওয়ার পর হেলিকপ্টার থেকে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি শুরু করল। আমার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন আমার এক প্রতিবেশী চাচা।

সবাই ভয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা হলো। আমি চাচার লাশের পাশে শুয়ে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টার আর দেখা যায় না। আমি তখন সেখান থেকে একটি গরুর গাড়িতে করে চাচার লাশ নিয়ে রওনা হলাম।

আরও পড়ুন