প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো

সংগ্রহকারী: মুন্নি আক্তার, দশম শ্রেণি (স্মৃতিকথা সংগ্রহের সময়), হাজী নূর উদ্দিন আহম্মদ উচ্চবিদ্যালয়, রূপসী, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ

বর্ণনাকারী: মো. শহীদুল মোল্লা, বরপা (সুতলার), রূপসী, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ

সংগ্রহকারী ও বর্ণনকারীর সম্পর্ক: নাতনি–প্রতিবেশী

তখন বর্ষাকাল, চারদিকে শুধু পানি আর পানি
অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। একদিন বিকেলে ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় চাচাতো ভাই আর তার বন্ধু এসে বলল, ‘চল, একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’

তখন বর্ষাকাল, চারদিকে শুধু পানি আর পানি। আমাদের ছিল দুটি নৌকা। সেই নৌকায় আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়লাম। যেতে যেতে দেখি, একটি খুঁটিতে তিনটি গ্রেনেড রশি দিয়ে প্যাঁচানো। দেখেই বুঝলাম, গ্রেনেডগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মারতেই বেঁধে রেখেছে পাকিস্তানি বাহিনী। তাই আমরা উঁচু খুঁটিতে উঠে গ্রেনেড তিনটি নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলাম।

বাড়িতে এসে দুটি গ্রেনেড অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেললাম। আর অন্য গ্রেনেডটি নিয়ে করে বসলাম ভীষণ ভুল। অতি আগ্রহের বশে গ্রেনেডের পিনটা খুলে বসলাম আমরা। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড, ঘরের চাল ফুটো হয়ে গেল। ঘর ভরে গেল ধোঁয়ায়।

আরও পড়ুন

আমরা তিনজনই আহত হয়ে ঘরে থেকে বের হয়ে এলাম কোনো রকমে। চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু হাঁটুপানি ভেঙে তার বাড়িতে চলে গেল। আমরা দুই ভাই রয়ে গেলাম আমাদের বাড়িতে। কোথাও গিয়ে যে চিকিৎসা নেব, তার কোনো উপায় নেই, চারদিকে পানি।

এদিকে গ্রেনেড বিস্ফোরণের শব্দে পাকিস্তানি বাহিনী পুরো গ্রাম ঘিরে ফেলল, পাহারা বসাল, যাতে একটা মানুষও গ্রামের বাইরে যেতে না পারে।

আমরা ভয়ে শেষ। রক্তে ঘর আর পরনের কাপড় সয়লাব। রক্তমাখা কাপড় কচুরিপানার নিচে লুকিয়ে রাখলাম। আমার মামা নৌকা দিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে শুরু করলেন, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামের ভেতরে এলে সবাইকে সতর্ক করে দিতে পারেন।

আরও পড়ুন

আমাদের অবস্থা তখন ক্রমেই খারাপের দিকে। জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। অনেক কষ্টে তারাবর দিকে একটি হাসপাতালে গেলাম, কিন্তু সেখানেও নিরাপত্তা নেই। তাই শেষমেশ এক পরিচিত চিকিৎসকের বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা নিলাম।

একসময় সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলাম আমরা। কিন্তু শরীরের পেছনে বোমার একটা খণ্ড থেকেই গেল। ভয়ে সেটা আজও অপারেশন করে বের করিনি। তবে এখন আর সমস্যা হয় না। সুস্থ দেহে দিব্যি হাঁটতে-চলতে পারি।

আরও পড়ুন