এমসি কলেজ থেকে যেভাবে পৌঁছলাম টেক্সাসের বিশ্ববিদ্যালয়ে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষে করপোরেট দুনিয়ায় চাকরি থেকে শুরু করে ফ্রিল্যান্স কাজেও সফল হচ্ছেন অনেক তরুণ। পড়ুন এমনই একজন—শাহজাহান ইসলাম এর গল্প। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়-কমার্সে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করছেন। কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন শাহজাহান?

শাহজাহান ইসলাম

সিলেটের জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছিলাম। আমাদের দেশে যাকে বলে ‘গোল্ডেন জিপিএ–৫’। ভালো ছাত্র ছিলাম বলে সবাই ধরেই নিয়েছিলেন, ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাব। আমি তখন বিদেশে স্নাতক করার সুযোগ খুঁজছিলাম। কিন্তু কোথাও হলো না। এর মধ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাও শেষ। পরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজে ভর্তি হই।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

এই কলেজ থেকেই পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক করেছি। আমাদের দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে পড়াকে সামাজিকভাবে অনেকটা হেয় করা হয়। আমার বন্ধুরা যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ভালো বিষয়ে পড়েছে, আমি এমসি কলেজে পড়ি বলে অনেকেই হেয় করতেন। সেশনজটের কারণে আমাদের ক্লাস ও ল্যাবের সুযোগ থাকত অনেক কম। পদার্থবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে ল্যাবক্লাসগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। অথচ সেটারই ঘাটতি ছিল।

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কয়েকজন শিক্ষক ভীষণ আন্তরিকতা নিয়ে আমাদের শেখাতে চেষ্টা করতেন। শুধু শিক্ষাক্রমের ধীরগতির কারণেই পিছিয়ে যেতাম। আমার পাস করার কথা ২০১৯ সালে। কিন্তু সেশনজট আর করোনার কারণে ২০২১ সালে স্নাতক করি। তবে করোনার সংকটের মধ্যেও পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছি। অনেক কিছু বুঝতাম না। তখন কলেজের শিক্ষক আবু আনাম মো. রিয়াজ, মো. নুরুজ্জামান, মোসাদ্দেক হোসেন খান স্যারসহ অনেকের পরামর্শ নিতাম। শিক্ষকেরা আমাকে সাহায্য করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাঁরা সাহস দিয়েছেন বলেই হতাশার মধ্যেও আলোর পেছনে ছুটেছি।

ভবিষ্যতের পেশাজীবনের কথা ভেবে সব সময় দুশ্চিন্তা কাজ করত। এরই মধ্যে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটা লেখা চোখে পড়ল। শিরোনাম ছিল—‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও দমে যাননি ইমরান’। জানলাম, ইমরান হোসেন আমার কলেজেই গণিত বিভাগ থেকে পড়েছেন। টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়-কমার্স থেকে পড়াশোনা শেষ করে ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-আর্লিংটনে পিএইচডি করছেন। সেই লেখা পড়ে আমি ভীষণ উজ্জীবিত হই। আমার কাছে এখনো সেই লেখার কপি আছে।

উচ্চশিক্ষার প্রতি আমার পরিবারের ভীষণ আগ্রহ ছিল। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। অনেক ভাইবোন আর কাজিনরা একসঙ্গে পড়াশোনা করেছি। ছোটবেলায় বাবাকে হারানোর পর আমাদের পাঁচ ভাইবোনের পথচলাটা কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আমার বড় ভাই সুলতান ইসলাম ২০১৬ সালে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে ফিনল্যান্ডে লাপ্রাতা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে ফিন্যান্সে মাস্টার্স করেছেন। এখন ব্লকচেইনের ওপর পিএইচডি করছেন ইউনিভার্সিটি অব ভাসাতে। বড় ভাইও আমার অন্যতম অনুপ্রেরণা। তাই সব সময় বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল।

তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় জিআরইসহ যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে শুরু করি। ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ থেকে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগগুলো জানতে পারি। পাশাপাশি প্রথম আলো থেকে নানা বৃত্তির খোঁজখবর পাই। সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে তৈরি করতে থাকি।

জিআরই পরীক্ষা দিয়ে আমার স্কোর হয় ৩০২। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার পর ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। শেষ পর্যন্ত টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়-কমার্স–এ ভর্তি হই। এখন আমি পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স অব সায়েন্স ডিগ্রির জন্য পড়ছি। এখন বিভাগের শিক্ষা সহযোগী হিসেবে কাজ করছি। আমার ইচ্ছা, ভবিষ্যতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে গবেষক হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় কাজ করব।

শাহজাহান ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সমস্যা থাকলেও শিক্ষার্থীরা চাইলেই নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই তৈরি করতে পারেন বলে আমি মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি কীভাবে ই–মেইল লিখতে হয়, কীভাবে স্টেটমেন্ট অব পারপাস লিখতে হয়, কিছুই জানতাম না। এসব আমাদের ক্লাসরুম থেকে শেখার সুযোগ নেই। কোনো শিক্ষার্থী যদি পরিকল্পনামতো নিজের ক্যারিয়ার সাজান, তাহলে সামনে যাওয়ার অনেক পথ আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই যে ভবিষ্যৎ নেই, এমনটা মনে করা যাবে না। আমি পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা তথ্য পেয়েছি। এখনকার শিক্ষার্থীদের বলব, নিজের পথ নিজেকে তৈরি করে সামনে এগিয়ে যেতে।