সামনের দিনগুলোতে তোমার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হয়ে থাকবেন মা-বাবাই

বলা হয়, ন্যাশনাল একাডেমি অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সদস্যপদ প্রকৌশল খাতের সর্বোচ্চ সম্মাননাগুলোর একটি। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সেই সম্মাননাই পেয়েছেন তাহের সাইফ। বুয়েটের এই স্নাতক এখন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়, আরবানা-শ্যাম্পেইনের অধ্যাপক। ৪ মে ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়টির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। পড়ুন তাঁর লিখিত বক্তৃতার নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

তাহের সাইফ
ছবি: খালেদ সরকার

ইউএপির সাবেক উপাচার্য, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে দিয়ে শুরু করি। আমরা বলতাম ‘জেআরসি স্যার’। বুয়েটে ছিলেন আমার শিক্ষক, থিসিসের উপদেষ্টা। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ মানুষটিই হয়ে উঠেছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু, পরম শুভাকাঙ্ক্ষী ও পরামর্শক। ২০১৮ সালে স্যার একবার অনুরোধ করলেন, আমি যেন ইউএপিতে একটি বক্তৃতা দিই। দিনটা ছিল ১৯ ডিসেম্বর। সেদিন সকালেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় পৌঁছেছি। বক্তৃতা দেওয়ার কথা বিকেলে। জেআরসি স্যারের সামনে কথা বলতে হবে ভেবেই যেন ৩৪ বছর আগের বুয়েটজীবনে ফিরে গেলাম, যেন আবারও একটি মৌখিক পরীক্ষা!

শেষ পর্যন্ত স্যারের প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে পেরেছিলাম ঠিকই; কিন্তু দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি আর ‘পরীক্ষার’ দুশ্চিন্তা মিলিয়ে আমার তখন জ্বর এসে গিয়েছিল। বিদায় নেওয়ার সময় স্যারের সঙ্গে হাত মেলাতেই বললেন, ‘তোমার তো জ্বর আসছে। বাসায় গিয়ে রেস্ট করো।’ তাঁর এই মমতা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। যেন সেই মুহূর্তেই তিনি একজন অভিভাবক হয়ে যত্নের চাদরে আমাকে ঢেকে দিলেন। প্রায়ই ভেবে অবাক হই, কীভাবে এত উচ্চতায় পৌঁছেও তিনি মাটিতে পা রেখে চলতেন; কীভাবে তাঁর জ্ঞান আর নির্দেশনায় আমাদের জীবন আর ক্যারিয়ার গড়ে দিলেন—কীভাবে বাংলাদেশের মানুষ আর বুয়েটিয়ানদের সাফল্য তাঁর জীবনের আনন্দ ও গৌরবের উৎস হয়ে উঠল; কেমন করে এমন অনুপ্রেরণাদায়ী হওয়া যায়; এমন মুক্ত, নির্ভীক মানুষ কীভাবে হয়। আমাদের জন্য, কিংবা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও তিনি অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।

আরও পড়ুন

আরেকটা ঘটনা বলি। বছর কয়েক আগের কথা। তখন ঢাকায় গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপ। ধানমন্ডি ১ নম্বর রোডে যানজটে আটকে আছি। হইহট্টগোলের মধ্যে একটি মেয়ে আমার নজর কাড়ল। ছয় কি সাত বছর বয়স। ঘুরে ঘুরে ফেসিয়াল টিস্যু বিক্রি করছিল। হাতে এক প্যাকেট মুড়ি। হয়তো ওটাই তার দুপুরের খাবার। মেয়েটিকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। চোখজোড়ায় মায়া। দেখে এত খারাপ লাগল! ওর কাছ থেকে এক প্যাকেট টিস্যু কিনলাম। কথা বলে জানলাম, যা রোজগার হয়, তা দিয়ে ও পরিবারকে সাহায্য করে। কৌতূহল নিয়েই জানতে চাইলাম, স্কুলে পড়ো? প্রশ্ন শুনেই আকস্মিক ওর চোখমুখ খুশিতে ঝলমল করে উঠল। বলল, সে প্রতি শুক্রবার সকালে দুই ঘণ্টার জন্য স্কুলে যায়। এই দুটি ঘণ্টা ওর কাছে অমূল্য, হয়তো এটুকুই ওর সুখ। তখন থেকেই মেয়েটির কথা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে আমার ছাত্রদের কাছেও মেয়েটির কথা বলেছি। যদি জানতাম, সে এখন কোথায়! সে কি কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখবে; তার কি কখনো চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার কথা ভাবার সাহস হবে; এখানে উপস্থিত আমাদের অনেকেরই যেমন স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, ওরও কি হবে?

আমি, তুমি, আমরা সৌভাগ্যবানদের দলে। তোমরা তোমাদের জীবনের একটি বড় মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে আছ। যে মাইলফলক পৃথিবীর অনেকের কাছেই একটি দূরবর্তী স্বপ্নের মতো। ভেবো না কেবল অদম্য স্পৃহা আর মেধার জোরেই এখানে পৌঁছেছ। এটি আদতে তোমার মা-বাবার অকুণ্ঠ সমর্থনের ফল। ভবিষ্যতের পথে, ক্যারিয়ারের যাত্রায় একটা কথা সব সময় মনে রেখো, সামনের দিনগুলোতে তোমার ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’ হয়ে থাকবেন মা-বাবাই। তাঁরাই তোমাকে নিয়ে ভাববেন। তাই তাঁদের খোঁজখবর রেখো। মনে রেখো, মা-বাবা তোমার কাছে নিজেদের জন্য কিছুই চান না। যা কিছু চান, তা তোমার ভালোর জন্য।

একদিকে মা-বাবা তোমাদের লালনপালন করেন। অন্যদিকে জ্ঞান আর দক্ষতায় তোমাকে পরিপূর্ণ করেন মেন্টর আর শিক্ষকেরা। মাঝেমধ্যে মনে হয়, প্রাথমিক স্কুলের যে শিক্ষক আমাকে প্রথম দুটি বর্ণ জুড়ে একটি শব্দ তৈরি করা শিখিয়েছিলেন, যদি তাঁর কাছে ফিরে যেতে পারতাম! সামনের দীর্ঘ পথের প্রথম পাথরটা তো তিনিই বসিয়েছিলেন। ক্লাসরুমের বাইরের পৃথিবীতে পা রাখার জন্য এই মেন্টররাই আমাদের প্রস্তুত করেন। তুমি হয়তো নানা ক্ষেত্র থেকে মৌলিক ধারণা ও নীতির দীক্ষা পেয়েছ। দলের সঙ্গে কাজ করা, সমস্যা সমাধান করা, অধ্যবসায়ের গুরুত্ব শিখেছ। বৈশ্বিক কর্মবাজারে প্রবেশের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করেছ। প্রবল মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে বাংলাদেশ ও সমগ্র পৃথিবীর আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা তোমার আছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে তুমি আরও জ্ঞান অর্জন করবে। কিন্তু যা-ই কোরো না কেন, সেটির মধ্যেই নিজের মনপ্রাণ ঢেলে দাও, নিজের সেরাটা দাও। যে চাকরিতেই ঢোকো না কেন, চাকরিদাতাকে যেন বলতে না হয় কেন তারা তোমাকে নিয়েছে। বরং তুমিই দেখিয়ে দাও, কেন তোমাকে নেওয়া হয়েছে। ইতিবাচক থাকো। শ্রদ্ধাশীল থাকো। সুবিবেচক হও। সেরা হও। তোমার ও তোমার আশপাশের মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করো, যেমনটা জেআরসি স্যার করেছেন। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত

আরও পড়ুন