যেভাবে আয়রনম্যান হলেন মিশু

গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিশু বিশ্বাস মায়লেশিয়ায় অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন সম্প্রতিছবি: সংগৃহীত

গোয়েন্দা শব্দটা শুনলেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কেমন সজাগ হয়ে ওঠে। শার্লক হোমস, এরকুয়েল পোয়ারো তো বটেই, বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত দুই গোয়েন্দা ফেলু মিত্তির আর ব্যোমকেশ বক্সী অজান্তেই এমন অভ্যাস গড়ে দিয়েছে হয়তো। বইয়ের গোয়েন্দা যে অভ্যাস গড়ে দিয়েছে, সেটাই যেন রয়ে গেল বাস্তব গোয়েন্দা মিশু বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময়। ফেব্রুয়ারির দুপুরে তাই খানিকটা পরিপাটি হয়েই বেরিয়ে পড়লাম রাজধানীর মিন্টো রোডের পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি অফিস) দপ্তরের দিকে। সদর দরজার নিয়মকানুন শেষ করে গোয়েন্দাদের ভবনে এলাম। চারতলার অফিস রুমে ঢোকার মুখেই যেন বুদ্ধির পরীক্ষা। জুতা খুলে ঢুকব নাকি পরে? বাইরে একাধিক জুতা খোলা দেখে খালি পায়েই প্রবেশ করলাম। একই সঙ্গে নিজেকে খানিকটা ‘বুদ্ধিমান’ ভেবে সুখও পেলাম। স্বাগত জানিয়ে হাত বাড়ালেন গোয়েন্দা মিশু বিশ্বাস।

মিশু বিশ্বাস এরই মধ্যে নিজের নানা সক্ষমতার জানান দিয়েছেন। পেশাগত সাফল্যের বাইরে দেখাচ্ছেন একের পর এক চমক। শেষ চমকটা দেখা গেল গত বছরের নভেম্বরে। মালয়েশিয়ায় আয়রনম্যান খেতাব জিতেছেন মিশু।

কঠোন অনুশীলনে নিজেকে ফিট করছেন মিশু বিশ্বাস
ছবি: কবির হোসেন

ছোটবেলার অনেকটা সময় কেটেছে ক্রিকেট মাঠে। ওই বয়সে আরও নানা কিছু করলেও সাঁতারটা সেভাবে শেখা হয়নি। অথচ সেই সাঁতার তিনি শিখেছেন বড়বেলায় এসে, মাত্র কয়েক দিনের চেষ্টায়। শুধু শেখার জন্য শেখা নয়, সাঁতার শেখার চার মাসের মধ্যে বাংলা চ্যানেলও পাড়ি দিয়েছেন মিশু। আর এবার তো মালয়েশিয়ায় গিয়ে পুরো তাক লাগিয়ে দিলেন। সাঁতার, সাইকেল চালানো আর দৌড় মিলিয়ে ২২৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে জিতেছেন আয়রনম্যান খেতাব।

চারমাস সাঁতার শিখে পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল
ছবি: সংগৃহীত

যেভাবে শুরু

এই সাফল্য মিশু বিশ্বাসের কাছে এসেছে ধাপে ধাপে। কীভাবে, সে গল্প শুনতেই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাসের সঙ্গে এই আড্ডা।

৩৩তম বিসিএসের কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দেন মিশু বিশ্বাস। শুরুতে ১ বছরের প্রশিক্ষণেই নানা রকম শারীরিক কসরত যা করার করেছেন। এরপর কাজে যোগ দিয়ে দিনরাত শুধু চোর-ডাকাত আর আইনশৃঙ্খলার কাজ সামলেছেন। নিজের ফিটনেস নিয়ে ভাবার সময় মেলেনি। কয়েক বছর পর তাঁর মনে হলো, ওজন বেড়ে গেছে। নিজের দৈনন্দিন কাজেও বিস্তর অসুবিধা হচ্ছে। অথচ পুলিশের চাকরিতে নিজেকে ফিট রাখা খুব জরুরি। সে ভাবনা থেকেই সুস্থ থাকতে দৌড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলেন মিশু বিশ্বাস।

সুস্থ থাকতে দৌড়ানোর অভ্যাস গড়ে তোলেন মিশু বিশ্বাস
ছবি: কবির হোসেন

তিনি বললেন, ‘তখনো রানিং বা ম্যারাথন যে একটা স্পোর্টস হতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা খুব একটা পরিষ্কার ছিল না। প্রতিদিনের শারীরিক ও মানসিক চাপ থেকে অবস্থার উন্নতির জন্যই দৌড়াতে শুরু করেছিলাম। এরপর একদিন মনে হলো, দেশের মধ্যে যে বিভিন্ন ম্যারাথন হয়, সেগুলোতে যাই। শুরু করলাম। দেশের মধ্যে কয়েকটা হাফ ম্যারাথনে অংশ নিয়ে আত্মবিশ্বাস পেলাম। এরপর গেলাম সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডের দুটি হাফ ম্যারাথনে।’

কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত একটি ম্যারাথনে অংশ নিয়ে ২০১৯ সালে তৃতীয় হন মিশু
ছবি: কবির হোসেন

দেশের ভেতর ও বাইরে বেশ কয়েকটি ম্যারাথনে দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মিশু বিশ্বাস ২০১৯ সালের শেষ দিকে অংশ নেন কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত একটি ম্যারাথনে। সেখানে তৃতীয় হয়ে আত্মবিশ্বাস পোক্ত হয় তাঁর। এবার তিনি দৃষ্টি দিতে শুরু করেন ভিন্ন দিকে। দৌড়াতে পারলে বাকিটা কেন নয়! সাঁতার শেখায় মন দিলেন এই পুলিশ কর্তা। কয়েক দিনের চেষ্টায় সেটা শিখেও গেলেন। এরপরই সাফল্য এল বাংলা চ্যানেল থেকে। ৬ ঘণ্টা সময় নিয়ে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত ১৬ দশমিক ১ কিলোমিটার সাঁতরে পাড়ি দেন সেবার। ২০২১ সালে মিশু বিশ্বাস অংশ নেন তুরস্কে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০ দশমিক ৩ প্রতিযোগিতায়। সেখানকার সাফল্যই তাঁকে ‘ফুল আয়রনম্যান’ প্রতিযোগিতায় নামতে উদ্বুদ্ধ করে।

পুলিশ কর্মকর্তা মিশু বিশ্বাস এর আগে তুরস্কে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০ দশমিক ৩ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশ থেকে এবার মোট ১৩ জন প্রতিযোগী ‘আয়রনম্যান মালয়েশিয়া’য় অংশ নেন। এর মধ্যে দুজন কম দূরত্বে, আর বাকিরা অংশ নেন পূর্ণ দূরত্বের প্রতিযোগিতায়। মিশু ১৩ ঘণ্টা ১৯ মিনিট সময় নিয়ে ২২৬ দশমিক ৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন সাইকেল চালিয়ে, সাঁতার কেটে ও দৌড়ে।

প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা

মালয়েশিয়ায় সাফল্যের পর মিশু বিশ্বাসের কাছে আয়রনম্যান চ্যালেঞ্জ এখন অনেকটা সহজই মনে হয়। তাই যেতে চান আরও কয়েকটি দেশের আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায়। ‘এ বছরই আরও এক বা দুটি দেশে আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চাই। পুলিশের চাকরিতে ব্যস্ততা অনেক, তাই নিজের কাজ সামলে ছুটি মিললে তবেই ছুটব,’ বলছিলেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিশু বিশ্বাস।

পুলিশের চাকরির ব্যস্ততা সামলে নিজের আনন্দের জন্য সাইক্লিং বা সাঁতার কাটেন মিশু
ছবি: কবির হোসেন

ছুটি যখনই মিলুক, নিজের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি রাখছেন না মিশু। অফিসের আগে ও পরে নিয়মিত প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন কঠোরভাবে। ছুটির দিনগুলোয় ভোরবেলায় উঠে বেরিয়ে পড়েন ঢাকা-মাওয়া হাইওয়ে কিংবা হাতিরঝিলে। কখনো দৌড়, কখনো সাইকেল চালিয়ে ঘাম ঝরান। জিমে গিয়ে পেশি ও স্ট্যামিনা বাড়ানোর কাজগুলো সারেন। সপ্তাহে তিন দিন সাঁতার, চার দিন সাইক্লিং, চার দিন দৌড় আর দুই দিন জিমের পেছনে সময় দেন। এ তো গেল প্রশিক্ষণ, আর খাবারদাবার? এই গোয়েন্দা খাবারের ব্যাপারে জানালেন, ‘প্রতিদিনের খাবারটা পাঁচ থেকে ছয়বারে খাই। প্রোটিন বেশি, কার্ব কম—এভাবেই খেতে চেষ্টা করি। সকালে নাশতায় কোনো দিন ওটস খাই, কখনো খাই রুটি, ডিম-সবজি। বেলা ১১-১২টার দিকে কিছু ফলমূল খাই। দুপুরে ১ কাপ ভাতের সঙ্গে ২৫০-৩০০ গ্রাম মাছ বা মাংসের মাধ্যমে প্রোটিন খাওয়ার চেষ্টা করি, সঙ্গে থাকে সবজি। বিকেলে পাঁচটার দিকে বাদাম-কলা ইত্যাদি খাই। সন্ধ্যায় কখনো ডিম খাই। রাতে কাজ শেষে নিজের প্রশিক্ষণ শেষ করে তারপর ডিনার করি সালাদ ও মুরগির মাংস দিয়ে।’

নিজের সীমাবদ্ধতাগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোই হচ্ছে আয়রনম্যানের মূল লক্ষ্য। আর সেই সঙ্গে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা। দুটোই সমানভাবে উতরে চলেছেন মিশু বিশ্বাস। গোয়েন্দা বলতে বাঙালির চোখে যে ফেলুদা বা ব্যোমকেশের ছবি ভাসে, মিশু বিশ্বাস যেন তার চেয়ে কোনো অংশে কম নন। শরদিন্দু যেমন তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘তাহার বয়স বোধ করি তেইশ-চব্বিশ হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়। গায়ের রং ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা, মুখেচোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে।’ বুয়েটের সাবেক ছাত্র মিশু বিশ্বাস যেন তেমনই। কঠোর অনুশীলন আর সুগঠিত চেহারার মধ্যে বুদ্ধির ছাপ স্পষ্ট। আর বয়স? সেটা তো অনুশীলন দিয়েই কমিয়ে নিয়েছেন এই বাংলাদেশি গোয়েন্দা।