অত বড় হতে চাই না, যত বড় হলে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়

আজ মা দিবসে মাকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী তাসমিয়াহ্ আফরিন

মায়ের সঙ্গে লেখক

পৃথিবীর সব মা-ই কি জাদুকর! তাই তো মনে হয়। এই যেমন আমার মা। শিল্প-সংগীতের চর্চা আমার পরিবারে ছিল না কখনোই। কিন্তু কেবল মায়ের জাদুর স্পর্শে কীভাবে যেন গান-অন্তঃপ্রাণ হয়ে গেলাম আমি। গল্পটা বলি। মায়ের কাছেই শোনা। যখন আমার বয়স তিন বছর, তখন কোনো এক দিন নাকি গুনগুনিয়ে গাইছিলাম কিছু একটা। ব্যস, মা বুঝে ফেললেন, তাঁর মেয়ের ভেতর শিল্পের প্রতিভা আছে। শুরু হলো আমাকে নিয়ে মায়ের শিল্পসংগ্রাম। প্রধানত, গান আর আবৃত্তির দিকেই ছিল আমার ঝোঁক। শহরের কোথায় আছে ভালো গানের স্কুল, কোথায় আবৃত্তিচর্চার সংগঠন—সব খোঁজ নিয়ে সেসব জায়গায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। শুধু তা–ই নয়, প্রতিটা জায়গায় আমাকে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, সব একা হাতে করতেন মা।

সংসার সামলে, রাজধানী শহরের এই ভয়ংকর যানজট ঠেলে মা আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যান। গান বা আবৃত্তি পরিবেশনার জন্য যখনই কোনো মঞ্চে উঠি, মা একদম সামনের সারিতে বসে থাকেন। নির্ভয়ে–নিশ্চিন্তে গান করি, কবিতা পড়ি। সবার মা-ই হয়তো এমনটা করেন। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন অন্য কারণে। আমাকে দেখেছেন, কিন্তু সঙ্গে আমার মাকে দেখেননি—পরিচিতজনেরা এমনটা বোধ হয় বলতে পারবেন না। আমি ঘরের বাইরে মানেই সঙ্গে আমার মা। এই যে সব সময় সঙ্গে সঙ্গে থাকা, এটি কিন্তু আমার নিরাপত্তাহীনতার চিন্তা থেকে নয়। তাহলে কেন? আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম মাকে। মা ঠিক বলতে পারেন না ব্যাপারটা। কিন্তু আমি বুঝি। মুগ্ধতার চোখ নিয়ে ছোট্ট মেয়েটার একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া দেখতে চান খুব কাছ থেকে—এই ভাবনাই তাঁর মাথায় থাকে। শুধু শিল্প-সংস্কৃতি নিয়েই মায়ের এমন আগ্রহ তা নয়; আমার পড়াশোনার ব্যাপারেও একদম সতর্ক।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

গান-কবিতা যেন আমার একাডেমিক পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়, সেদিকেও তীক্ষ্ণ নজর তাঁর।  
মায়ের ছোট্ট মেয়েটা বড় হয়ে গেল একদিন। ভর্তি হলো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট)। তাতে আমার না যতটা শ্রম, তার চেয়ে শতগুণ বেশি শ্রম মায়ের। এখন একা একা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই, বাসায় ফিরি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করি। সব সময় মা সঙ্গে যান না। চারপাশে প্রচুর বন্ধুবান্ধব। আমার সব বন্ধুই মায়েরও বন্ধু হয়ে গেছে। কিন্তু কোথাও গেলে অনেক বন্ধুর ভিড়েও আমার বেশ একা লাগে। দৌড়ে বাসায় ফিরেই ঝাঁপিয়ে পড়ি মায়ের কোলে। মা কপট বিরক্তি দেখান—ইশ্‌, কত বড় হয়ে গেছে, এখনো ছেলেমানুষি গেল না! আমি মায়ের গলা ঝুলে থাকি। বলি, মা, অত বড় হতে চাই না, যত বড় হলে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়!