চতুর্থ স্টেজের ক্যানসার ধরা পড়ার আট বছর পরও লড়ে যাচ্ছেন মঞ্জুশ্রী

‘ক্যানসার’ শব্দটার মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে একটা চাপা আতঙ্ক। তার ওপর তা যদি হয় চতুর্থ স্টেজের ক্যানসার, মনোবল হারিয়ে ফেলাটা অস্বাভাবিক নয়। নভেম্বর মাস ফুসফুস ক্যানসার সচেতনতা মাস। চতুর্থ স্টেজে ফুসফুসের ক্যানসার ধরা পড়ার পরও আট বছর ধরে লড়াই চালিয়ে যাওয়া মঞ্জুশ্রী কুন্তলা দত্তর জীবনের গল্প জানুন এই নভেম্বরে। লিখেছেন রাফিয়া আলম

চতুর্থ স্টেজের ক্যানসার ধরা পড়ার আট বছর পরও লড়ে যাচ্ছেন মঞ্জুশ্রীছবি: মঞ্জুশ্রী কুন্তলা দত্তের পরিবারের সৌজন্যে। গ্রাফিকস: প্রথম আলো

২০১৭ সাল। বরিশালের মঞ্জুশ্রী কুন্তলা দত্ত দিব্যি ঘরকন্না করছেন। জানুয়ারি মাসে হঠাৎ কাশি হলো ৪৮ বছর বয়সী এই নারীর। খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই মৌসুমে এমন উপসর্গকে সাধারণ বিষয় ধরে নিয়েছিলেন স্থানীয় চিকিৎসক।

তাঁর নির্দেশনামাফিক কিছু ওষুধ সেবনের পর সেরেও উঠলেন মঞ্জুশ্রী। পরে আরও দুয়েকবার কাশি হলো। সঙ্গে বুকে ব্যথা। বুকটা একটু ভারও মনে হতো তখন। আবারও সেখানকার চিকিৎসায় সেরে উঠলেন।

বিপত্তি বাধল নভেম্বর মাসে, যখন কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে এল। মঞ্জুশ্রীর একমাত্র সন্তান তিলোত্তমা দত্ত তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ঢাকায় নিয়ে আসা হলো মঞ্জুশ্রীকে। ভর্তি করা হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বুকের সিটি স্ক্যানে ধরা পড়ল টিউমার। ব্রঙ্কোস্কপির মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হলো। রিপোর্টে ধরা পড়ল ক্যানসার।

আরও পড়ুন

চতুর্থ স্টেজে ক্যানসার

ক্যানসার ধরা পড়ার পর মাকে নিয়ে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডে এলেন তিলোত্তমা। সেখানকার ক্লিনিক্যাল অনকোলজি অ্যান্ড রেডিওথেরাপি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেনের অধীন শুরু হলো চিকিৎসা। ক্যানসারটা চতুর্থ স্টেজের।

মঞ্জুশ্রীর বুকে তখন পানি জমে গেছে। সেই পানি বের করার ব্যবস্থা করা হলো। ফুসফুসের পর্দার দুটি স্তরকে আটকে দেওয়া হলো বিশেষ প্রক্রিয়ায়। টিউমারের মলিকুলার স্টাডির (আণবিক পরীক্ষা) জন্য নমুনা পাঠানো হয়েছিল ভারতের বেঙ্গালুরুতে। রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হলো টার্গেটেড থেরাপি।

চিকিৎসা হলো যেভাবে

সহজভাবে বলতে গেলে টার্গেটেড থেরাপি হলো এমন চিকিৎসাপদ্ধতি, যা কেবল নির্দিষ্ট কোষের ওপরেই কাজ করে। অর্থাৎ দেহের বাকি কোষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না এই চিকিৎসায়।

তবে এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ খুঁজে পেতে বেশ ভুগতে হয়েছে মঞ্জুশ্রীর পরিবারকে। ২০১৯ সাল থেকে এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর মা হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে মঞ্জুশ্রীকে নানাভাবে সহায়তা করতে শুরু করে।

মাঝে ২০১৮ সালে মঞ্জুশ্রীর পেট সিটি স্ক্যানে ধরা পড়েছিল, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়ে। তাই দিতে হলো রেডিওথেরাপিও। অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেনের পরামর্শেই মাঝে মুম্বাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মঞ্জুশ্রীকে।

তবে স্কয়ারেই চিকিৎসা চালিয়ে যায় মঞ্জুশ্রীর পরিবার। অবশ্য ভর্তি থাকতে হয়নি একবারও। ২০১৯ সালের বোন স্ক্যান রিপোর্টে আর কোনো অস্বাভাবিকতাও ছিল না।

আরও পড়ুন

সুস্থ জীবনে মঞ্জুশ্রী

ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ওঠেন মঞ্জুশ্রী। তবে টার্গেটেড থেরাপি চালিয়ে যেতে হয়েছে সব সময়ই। আজীবনই চালিয়ে যেতে হবে এই চিকিৎসা। ঠিকঠাক চিকিৎসা নেওয়ায় মারাত্মক পরিস্থিতি থেকেও মঞ্জুশ্রী ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে।

মঞ্জুশ্রীর মেয়ে তিলোত্তমা বলছিলেন, ‘অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. আকরাম হোসেন স্যার এমনভাবে চিকিৎসার পুরো প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে নির্ধারণ করেছেন, যাতে আমার মায়ের ভয়াবহ শারীরিক কষ্টের উপশম হয়। চতুর্থ স্টেজ ক্যানসার থেকে সুস্থ জীবনে ফেরাটা সত্যিই বিশাল ব্যাপার। এখনো তাঁর তত্ত্বাবধানেই আছেন মা।’

মায়ের লড়াইয়ের সঙ্গী তো তিলোত্তমা নিজেই। মেডিকেল কলেজের পড়ালেখা আর পরীক্ষার চাপ সামলে মাকে নিয়ে তিলোত্তমা লড়েছেন প্রতিটা দিন। ২০২২ সালে চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর ইন্টার্নশিপ শেষ করে প্রবেশ করেন পেশাগত জীবনে।

নতুন লড়াইয়ে

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ভালোই চলছিল সব। তবে এরপর মঞ্জুশ্রীর আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়। পরে পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ধরা পড়ে, মস্তিষ্কে ছড়িয়েছে টিউমার। আবারও রেডিওথেরাপি দেওয়া হয় তাঁকে।

আর টার্গেটেড থেরাপি তো চলছেই। আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছেন মঞ্জুশ্রী। বাসার ভেতর দিব্যি হাঁটাচলা করেন। আচরণে এখন কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।

তিলোত্তমার জীবনে আজও আছেন তাঁর পরম মমতাময়ী মা। মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ার সময় থেকে স্বাভাবিকভাবেই জীবনের বহু রঙিন মুহূর্ত আর দশজন মানুষের মতো করে উপভোগ করার সুযোগ হয়নি তিলোত্তমার।

মায়ের জন্য জীবনের সব চ্যালেঞ্জ হাসিমুখে সামলাচ্ছেন এই চিকিৎসক। মায়ের আদরের কোমলতম স্পর্শটুকু থাকুক তাঁর সঙ্গে, কেবল এটুকুই তাঁর প্রত্যাশা।

আরও পড়ুন