সিজারিয়ান করা মায়েদের যে সমস্যাগুলো হতে পারে

মা ও তাঁর সন্তানের কল্যাণের জন্য একজন চিকিৎসককে কখনো কখনো সিজারিয়ান অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়ছবি: পেক্সেলস

বলা হয়ে থাকে, প্রসবযন্ত্রণার চেয়ে তীব্র ব্যথা আর নেই। তবে প্রতিটি মাতৃত্বের গল্পই আলাদা। একজন নারী দুবার সন্তান প্রসব করলে তাঁর নিজেরই দুই রকম অভিজ্ঞতা হতে পারে। একজনের মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা তাই অন্যজনের সঙ্গে মেলে না। সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হলে প্রসবযন্ত্রণা পোহাতে হয় না ঠিক, তবে অপারেশন–পরবর্তী ঝক্কিও কিন্তু কম নয়।

সন্তান প্রাকৃতিক নিয়মে জন্ম নেবে, এটাই স্বাভাবিকতা। তবে মা ও তাঁর সন্তানের কল্যাণের জন্য একজন চিকিৎসককে কখনো কখনো সিজারিয়ান অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার প্রসবযন্ত্রণা এড়ানোর জন্য কোনো কোনো মা নিজ ইচ্ছাতেও সিজারিয়ান অপারেশন করাতে চান। আদতেই কি এটা স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে সুবিধাজনক?

স্কয়ার হাসপাতাল লিমিটেডের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট কনসালট্যান্ট ডা. আনিকা তাবাস্‌সুম বলেন, ‘মা ও তাঁর গর্ভের সন্তানের কোনো শারীরিক অসুবিধা না থাকলে স্বাভাবিক প্রসবের পরিকল্পনাই করা উচিত। একজন প্রশিক্ষিত ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে স্বাভাবিক প্রসব নিরাপদ। তবে প্রসবের সময় যেকোনো বিপদচিহ্ন দেখা দিলে দ্রুততম সময়ে একজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়ার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। প্রসবযন্ত্রণা এড়ানোর জন্য সিজারিয়ান অপারেশনকে একটি বিকল্প উপায় ভেবে নেওয়া উচিত নয়। বরং ব্যথামুক্ত স্বাভাবিক প্রসবের পরিকল্পনা করা যেতে পারে।’

এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকেই এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক:

সিজারিয়ান অপারেশনের ব্যথা

সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তানের জন্ম হলে মা তাৎক্ষণিক প্রসবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেও অপারেশনের পর কিন্তু ব্যথায় ভুগতে হয় ঠিকই। এ ব্যথা রয়ে যায় বেশ কিছুদিন। ব্যথানাশক দেওয়া হলেও অনেকটাই ব্যথা সইতে হয়। ওদিকে সন্তানের পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা নিশ্চিত করতে তাকে শালদুধ দেওয়া খুবই জরুরি। মায়ের দুধের ওপরই নির্ভর করে থাকে ওই একরত্তি প্রাণ। অপারেশনের ব্যথা সয়ে নবজাতককে সঠিক ভঙ্গিতে দুধ খাওয়াতেও সমস্যায় পড়েন অনেক মা। হাসপাতালে থাকতেও হয় কয়েকটা দিন। ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়ার পর ওই জায়গার ত্বকে কাপড় ঘষা লেগেও হতে পারে ব্যথা বা অস্বস্তি। নড়াচড়া করতে গেলে তলপেটে টান লাগতে পারে। অপারেশনের ধকল কাটাতে অনেকটাই সময় লেগে যায়।

আরও কিছু জটিলতা

  • অপারেশনে কারও কারও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতে পারে, অপারেশনের পর কাটা জায়গায় হতে পারে সংক্রমণ।

  • অপারেশনের পর ঠিকঠাক হাঁটাচলা না হওয়ায় কোষ্টকাঠিন্যও হতে পারে। বাথরুমে গিয়ে তলপেটে খুব একটা বেশি চাপ দেওয়ার মতো অবস্থায়ও থাকেন না সদ্য অপারেশন করিয়ে আসা মা।

  • অপারেশনের পর ছয় মাস ভারী কাজ করতে নিষেধ করা হয়। নিয়ম না মানলে তৈরি হয় হার্নিয়ার ঝুঁকি। বিশেষ করে কারও যদি দুবারের বেশি সিজারিয়ান অপারেশন হয়, তাঁর পেটের পেশি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে কাশি বা কোষ্টকাঠিন্য থাকলেও এই দুর্বল পেশির কারণে হার্নিয়া হতে পারে।

  • কিছু ক্ষেত্রে সিজারিয়ান অপারেশনের বেশ কয়েক বছর পরও কাটা জায়গায় ব্যথা হতে পারে।

  • দু-তিনবার সিজারিয়ান অপারেশন করা হলে পরবর্তী গর্ভধারণের সময় কারও কারও ক্ষেত্রে গর্ভফুলজনিত জটিলতার ঝুঁকি বাড়ে।

অপারেশনের জটিলতা কমাতে

আগে থেকেই রক্তদাতা জোগাড় করে রাখুন। অপারেশনের পর কাটা জায়গার যত্ন নিতে হবে সঠিক নিয়মে। হাঁচি, কাশি, এমনকি হাসির সময়ও কাটা জায়গায় একটা বালিশ বা তোয়ালে চেপে ধরা যেতে পারে। নিয়ম অনুযায়ী অ্যাবডোমিনাল বাইন্ডার ব্যবহার করা ভালো। নরম কাপড়ের ঢিলেঢালা পোশাক পরা উচিত। ইলাস্টিক বা ফিতার অবস্থান হওয়া উচিত কোমরের চেয়ে ওপরে।

আরও পড়ুন

স্বাভাবিক প্রসবে স্বাভাবিক জীবন

প্রসবযন্ত্রণার তীব্রতা নিঃসন্দেহেই সিজারিয়ান অপারেশনের ব্যথার চেয়ে অনেক বেশি। তবে প্রসবযন্ত্রণা একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। স্বাভাবিক প্রসবের পর জলদিই সেরে ওঠেন মা। তাঁর জন্য সন্তানের যত্ন নেওয়াও সহজ হয়। স্বাভাবিক প্রসবের সময় যোনিপথের সামনের চামড়ার সামান্য অংশ কেটে দেওয়া হয়। এর নাম এপিসিওটোমি। তাতে প্রসবের সময় প্রচণ্ড চাপে জরায়ুমুখ ছিঁড়ে যাওয়ার ঝুঁকি এড়ানো যায়। আর এখন ব্যথামুক্ত প্রসবও সম্ভব। এপিডুরাল অ্যানালজেসিয়ার কল্যাণে প্রসবযন্ত্রণার তীব্রতা কমানো যায়।

চাই সঠিক সিদ্ধান্ত

স্বাভাবিক প্রসবের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মা ও গর্ভের শিশুর সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করা প্রয়োজন। মায়ের বয়স খুব কম বা খুব বেশি হলে, গর্ভাবস্থায় মা কোনো অসুস্থতা বা জটিলতায় ভুগলে কিংবা শিশুর আকার খুব বড় বা খুব ছোট হলে স্বাভাবিক প্রসব করানো নিরাপদ না-ও হতে পারে। গর্ভের সন্তানের মাথা ছাড়া অন্য অংশ যদি নিচের দিকে থাকে, সে ক্ষেত্রেও স্বাভাবিক প্রসবে ঝুঁকি থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরি, তাতে এ ধরনের যেকোনো সমস্যার ব্যাপারে আগে থেকেই জানা সম্ভব হয়। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। গর্ভাবস্থায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর কমপক্ষে চারবার চেকআপের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাও রয়েছে।

আরও পড়ুন