ডায়াবেটিস মেলা কেন জরুরি
নভেম্বর ডায়াবেটিস সচেতনতা মাস। এ উপলক্ষে কংগ্রেসিয়া ও প্রথম আলোর আয়োজনে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন দেশের কয়েকজন স্বনামধন্য চিকিৎসক। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ডায়াবেটিস আমার, দায়িত্বও আমার’। সহযোগিতায় ছিল হেলদি লিভিং ট্রাস্ট। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন।
ডায়াবেটিস পরীক্ষার পাশাপাশি রেটিনা পরীক্ষা প্রয়োজন
ডা. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ভিট্রিও-রেটিনা সোসাইটি এবং কনসালট্যান্ট, ভিট্রিও-রেটিনা ভিশন আই হসপিটাল
সাধারণ জনগণকে আমরা অনেক দিন ধরে একটি বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি। সেই বার্তা হলো, আমাদের দেশে ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতা আছে। আমাদের দেশের ডায়াবেটিস রোগীরা অন্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো সেবা পান। কারণ, বিভিন্ন জায়গায় ডায়াবেটিক সেন্টার আছে, ডায়াবেটিক সমিতি আছে। প্রায় ৫০ শতাংশ রোগীর হাতে একটি বই থাকে, যেখানে লেখা থাকে প্রতি মাসে একবার দেখাতে হবে। তাঁদের নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকে ক্রিয়েটিনিন, লিপিড প্রোফাইলসহ নানা পরীক্ষা। কিন্তু যে জিনিসটি হয় না, সেটি হলো চোখের পরীক্ষা। বইয়ে চোখের ডাক্তার দেখানোর কলাম থাকলেও, বাস্তবে তাঁরা চোখের ডাক্তার দেখাচ্ছেন আর ডাক্তার চশমা দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন। রেটিনার পরীক্ষা হচ্ছে না।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে প্রায় ২ হাজার রেজিস্টার্ড চক্ষুবিশেষজ্ঞ থাকলেও তাঁদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ রেটিনা পরীক্ষা করার মতো ক্লিনিক্যালি এক্সপার্ট। ফলে সঠিক রেফারাল না হওয়ায় অনেক রোগী দেরিতে আসেন। আরেকটি সমস্যা হলো সমন্বয়ের অভাব। একজন রোগী যখন দৃষ্টিহীনতার কারণে আমার কাছে আসেন, আমি যদি দেখি তিনি ডায়াবেটিক, তখন আমার উচিত তাঁর কিডনি পরীক্ষা হয়েছে কি না জেনে নেওয়া বা করিয়ে দেওয়া। কিন্তু আমরা অনেক সময় তা করি না। একইভাবে যিনি কিডনির চিকিৎসক, তাঁরও উচিত রোগীকে রেটিনা পরীক্ষা করতে বলা। এভাবে চিকিৎসকদের মধ্যে সমন্বয় দরকার। আমরা রোগীদের নানা মাধ্যমে বার্তা দিচ্ছি। নিয়মিত ডায়াবেটিস চেকআপের পাশাপাশি বছরে অন্তত একবার রেটিনা পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এখন অনেকে এই বার্তার কারণে চিকিৎসা নিতে আসছেন।
আমরা চিকিৎসকদের মধ্যেও আন্তসম্পর্ক বাড়ানোর কিছু প্রস্তাব রেখেছি। আগামী বছর রেটিনা সোসাইটির কনফারেন্সে আমরা একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ সেশন রাখব, যেখানে নেফ্রোলজিস্টসহ বিভিন্ন সাবস্পেশালিটির চিকিৎসকদের আমন্ত্রণ জানানো হবে। যেমন কোন ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম করা যাবে বা যাবে না, চোখের ইনজেকশন কিডনিতে কী প্রভাব ফেলে—এসব বিষয়ে পরস্পরের মতবিনিময় হবে। এতে সচেতনতা ও যোগাযোগ বাড়বে। আরেকটি উদ্যোগ হতে পারে ডায়াবেটিক সোসাইটি ও রেটিনা সোসাইটি মিলে সচেতনতামূলক একটি পোস্টার তৈরি করা, যা সব ডায়াবেটিক সেন্টার ও রোগীর অপেক্ষমাণ কক্ষগুলোতে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। রোগীরা অন্তত পড়ে জানতে পারবেন যে চোখের রেটিনা পরীক্ষাও অত্যন্ত জরুরি।
আরেকটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাব হলো, প্রতিটি হাসপাতাল বা ইনস্টিটিউটে একটি ফান্ডাস ক্যামেরা রাখা। সাত-আট লাখ টাকায় একটি ক্যামেরা কেনা যায়। এটি দিয়ে ছবি তুলে সহজেই বোঝা যায় রেটিনায় সমস্যা আছে কি না। টেকনিশিয়ানও পরিচালনা করতে পারেন। চিকিৎসক শুধু রিপোর্ট দেখে প্রয়োজন হলে রেফার করবেন। এতে রোগীদের কোথাও পাঠানোর প্রয়োজন নেই। যেসব এলাকায় চক্ষুবিশেষজ্ঞ নেই, সেখানে ছবিগুলো অনলাইনে সেন্ট্রাল সিস্টেমে পাঠিয়ে স্ক্রিনিং করানো সম্ভব। সারা বিশ্বেই এখন এমনভাবে স্ক্রিনিং হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ শত শত ছবি দেখে বের করে দিতে পারেন, কোন রোগীদের রেফার করা দরকার। এটি করা সম্ভব হলে দেশের সর্বত্র রেটিনা স্ক্রিনিং সহজ হয়ে যাবে।
সচেতনতাই ডায়াবেটিস কমিয়ে আনতে পারে
ইফতেখারুল ইসলাম, ব্যবস্থাপনা পরামর্শদাতা ও সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, ডায়াবেটিস মেলা
অনেকেই ইতিমধ্যে আলোচনা করেছেন। শুরুতেই বলে রাখা ভালো, আমি দীর্ঘদিন ওষুধশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এবং এখনো ব্যবস্থাপনা পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে ওষুধের প্রাপ্যতা নিয়ে আমি কোনো অভিযোগ শুনিনি। এর কৃতিত্ব আমার বহু সহকর্মীর, যাঁরা ৩০ বছর ধরে ওষুধশিল্পে কাজ করছেন। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় মুখে খাওয়ার ওষুধ বা ইনসুলিনের কোনো সংকট নেই। এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন। এর সুফল রোগীরা পাচ্ছেন, চিকিৎসকেরাও পাচ্ছেন।
সচেতনতা তৈরির যে প্রয়োজন, সেটি নিয়ে সবাই একমত। সূচনা বক্তব্যে আমরা শুনেছি ডায়াবেটিস বহুলাংশে প্রতিরোধযোগ্য, তবু এটি বাড়ছে। যা ইঙ্গিত করে, এ বিষয়ে শিক্ষা ও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। সচেতনতা গড়ে ওঠে দুটি পর্যায়ে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পর্যায়ে, আরেকটি সামাজিক পর্যায়ে। সমাজে আমাকে যে প্রভাবিত করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করে সচেতনতা কতটা কার্যকর হবে।
এখানে একটি সমস্যা অনেক দিন ধরে তৈরি হয়েছে, আমাদের রোল মডেলরা ক্রমেই আড়ালে চলে যাচ্ছেন। আমরা কাউকে সহজে বিশ্বাস করি না। গণমাধ্যমে একসময় কিছু ছাপা হলে সেটিকে আমরা আস্থার সঙ্গে গ্রহণ করতাম, এখন কি আমরা তা করি? পরিস্থিতি যদি এমন হয়, তাহলে সচেতনতা তৈরি করব কীভাবে? এই ভঙ্গুর ও সন্দেহপ্রবণ সমাজকে প্রভাবিত করতে হলে, আরও শক্তিশালী মাধ্যম ও উৎস প্রয়োজন। আস্থাভাজন মানুষ আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
কোন কোন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার, তা আপনারা বলেছেন। স্বাস্থ্য, ওজন, জীবনযাপন, শারীরিক পরিশ্রম, খাদ্যাভ্যাস, বিশ্রাম এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে প্রি–ডায়াবেটিক মানুষের ক্ষেত্রে সচেতনতা ও সতর্কতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; কারণ তাতে আমরা ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমাতে পারি। এতে চিকিৎসার চাপও কমবে।
ওজন নিয়ন্ত্রণ বা ওবেসিটির বিষয়ে সমাজে পরিভাষাগত জটিলতা তৈরি হয়েছে। বডি শেমিংয়ের মতো প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলা কঠিন। কাউকে কিছু গ্রহণ করানোও কঠিন। তাই সাধারণ সচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি। আমার শেষ কথা, সচেতনতার পাশাপাশি আমাদের আস্থাভাজন মানুষ ও গণমাধ্যম তৈরি করতে হবে। আবার পরামর্শ শোনার মানসিকতাও গড়ে তুলতে হবে।
ডায়াবেটিস মেলায় দরকারি তথ্য মেলে
ডা. মো. ফজলে রাব্বী খান, প্রধান সমন্বয়ক, ডায়াবেটিস মেলা, সেক্রেটারি জেনারেল, হেলদি লিভিং ট্রাস্ট
আমাদের সমাজে ২০ থেকে ৭৯ বছর বয়সের মধ্যে দুটি ধারা দেখা যায়। এক. যাঁদের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগের এক বা একাধিক ঝুঁকি সৃষ্টিকারী কারণ আছে। (স্থূলতা, বংশে কারও না কারও এই রোগ থাকা কিংবা প্রয়োজনীয় কায়িক শ্রম না করা। তাঁরা মনে করেন, আমার তো এভাবেই বেশ চলছে, আমার ডায়াবেটিস হবে না। তাঁরা আসলে ততক্ষণে প্রি-ডায়াবেটিস অবস্থায় আছেন। তাঁদের সংখ্যা আমাদের সমাজে পুরুষদের মধ্যে শতকরা ১৭ ভাগ আর নারীদের মধ্যে ২৩ ভাগ। শুধু সঠিক ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন না মানার জন্য তাঁদের কারও কারও হঠাৎ করেই ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আর এই সংখ্যাটাও কম নয়, এই প্রি-ডায়াবেটিসের শতকরা ১৫ থেকে ৩০ ভাগ ডায়াবেটিসে আত্রান্ত হন।
দুই. এই দলে পড়বেন তাঁরা, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভুগছেন। প্রথম দিকে অল্প ডায়াবেটিস, পরে অনিয়ন্ত্রিত। তাঁদের সংখ্যাও কিন্তু কম না, পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতি ৮ জনে ১ জন। তাঁরা মনে করেন, ভালোই তো আছি, এভাবেই তো চলছে। হঠাৎ করেই এই দলের নানা জটিলতা শুরু হয়ে যায়। একদম ভূমিকম্পের মতো, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই আঘাত করে।
এই দুই ধরনের মানুষের যদি আমরা সময়মতো কার্যকর ও সঠিক পরামর্শ সহায়তা দিতে পারি, তবে ভালো ফল মিলতে পারে। বিশেষ করে প্রথম দলে থাকা মানুষদের ডায়াবেটিস হওয়া কিছুটা বিলম্বিত করা যাবে, এমনকি অনেককে রক্ষাও করা যাবে। আর দ্বিতীয় দলের মানুষদের তাঁর চোখ ও কিডনি বিকল হওয়া থেকে, হৃদ্রোগ বা স্ট্রোকের মতো নানা জটিলতা থেকেও রক্ষা করা যাবে।
কাজেই শুরুতে প্রয়োজন, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ও আক্রান্ত হতে পারে, এমন মানুষদের চিহ্নিত করা। তাঁদের প্রয়োজনীয় তথ্য সহায়তা দেওয়া ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন সম্পর্কে সচেতন করা। যেন রোগী বা হবু ডায়াবেটিস রোগী নিজেরাই নিজের ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো করতে পারেন। চিকিৎসক শুধু আপনাকে গাইড করবেন, নিয়মিতভাবে আপনার রক্তের সুগার আপনাকেই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
এ রকম একটা উপলব্ধি থেকেই আমরা ২০১৯ সাল থেকে ডায়াবেটিস মেলা আয়োজন করছি। বইমেলায় বই মেলে, বাণিজ্যমেলায় মেলে বাহারি জিনিসপত্র। তবে ডায়াবেটিস মেলায় ডায়াবেটিস পাওয়া যাবে না, পাওয়া যাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নানা তথ্য। এই রোগকে অযথা ভয় না পেয়ে, আতঙ্কিত না হয়ে এই প্ল্যাটফর্মে মানুষ আসেন ডায়াবেটিস–সংশ্লিষ্ট প্রথিতযশা চিকিৎসকদের মুখ থেকে কথা শুনতে। নিজেদের সমৃদ্ধ করতে।
আমরা চেস্টা করছি, ডায়াবেটিসের যত্ন ও সেবাদানকারী সব প্রতিষ্ঠানকে একই ছাতার নিচে আনতে। আর ডায়াবেটিস রোগীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে। যেখানে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা, বিভিন্ন কর্মশালা ও বক্তৃতা ছাড়াও হাতে–কলমে ডায়াবেটিসের যত্ন ও নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেওয়া হয়।