‘এক আত্মীয় তার মুঠোফোনে আমাকে একটি নোংরা ছবি দেখিয়েছিল’

পাঠকের কাছ থেকে মনোজগৎ, ব্যক্তিজীবন ও সন্তান পালনের মতো সমস্যা নিয়ে ‘পাঠকের প্রশ্ন’ বিভাগে নানা রকমের প্রশ্ন এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম নির্বাচিত একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবার।

মেহতাব খানম
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন: আমি একজন নারী। আমার বয়স যখন ৭ বছর, এক আত্মীয় তার মুঠোফোনে আমাকে একটি নোংরা ছবি দেখিয়েছিল। আম্মুকে জানানোর পর সেই লোকটাকে আমাদের বাড়িতে আসা নিষিদ্ধ করেন আব্বু-আম্মু। তার পর থেকে লোকটা আমাকে দেখলে কেমন করে যেন তাকাত, দেখে আমার ভয় লাগত। ছোটবেলার ওই ঘটনার পর থেকে যৌনতাবিষয়ক সবকিছুকে ভয়াবহ মনে হতো। এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। একটি ছেলের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক চলছে। তার সঙ্গেও আমি সহজ হতে পারি না। সে আমার হাত ধরলেও আমার সংকোচ হয়, আড়ষ্ট লাগে। ছেলেটিও সেটা বুঝতে পারে, তাই সে বেশ দূরত্ব বজায় রাখে। এভাবে চলতে থাকলে আমার ব্যক্তিজীবন কোনো ক্ষতির মুখে পড়বে কি না, বুঝতে পারছি না। আমার আসলে কী করা উচিত?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

উত্তর: এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে আত্মীয়টি তোমার সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করেছে। সে তোমাকে আপত্তিকরভাবে স্পর্শও করেছিল কি, যেটি তুমি জানাওনি? যদি সেটি না ঘটে থাকে, তাহলে বলতে হবে, তুমি অন্তত কিছুটা রক্ষা পেয়েছ। তবে এটিকে শিশু যৌন নির্যাতনই বলা চলে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, সারা পৃথিবীতেই ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে শিশুরা এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময় তারা বুঝতেও পারে না, তাদের সঙ্গে কী ঘটে যাচ্ছে। তোমার ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি ইতিবাচক, তা হলো তুমি অকপটে মাকে সেটি বলতে সক্ষম হয়েছ। সঙ্গে সঙ্গেই উদ্যোগ নিয়ে তাঁরা সেই লোকটির প্রবেশাধিকার তোমার বাড়িতে নিষিদ্ধ করেছেন। এতে আরও বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে তুমি রক্ষা পেয়েছ।

আমার জানামতে, শিশুরা যদিও–বা বুঝতে পারে যে তার সঙ্গে খারাপ কিছু ঘটেছে, সাহস করে বড়দের কাউকে বলতে না পেরে একাই কষ্ট পেতে থাকে। অনেক সময় তার মনে কিছুটা অপরাধবোধও তৈরি হয়ে থাকে। আরও বড় হওয়ার পর সে নিজেকে দোষারোপ করতে থাকে এই মনে করে যে কেন সে তীব্র প্রতিবাদ করে মানুষটিকে থামিয়ে দেয়নি। মানুষটি তোমার আত্মীয় হওয়ার কারণে বাড়িতে এলেও তোমাকে তাকে দেখতে হয়েছে, তার তাকানোর ভঙ্গি আবার তোমাকে আগের নেতিবাচক অনুভূতির ভেতর দিয়ে নিয়ে গেছে। এই কারণেই এটি তোমার মধ্যে সম্ভবত একটি অজানা ভয়ের সৃষ্টি করেছে।

এই ভীতিকর অনুভূতি বা মানসিক ট্রমা আমাদের অবচেতনে সাধারণত থেকে যায়। যদি সে তোমার আত্মীয় না হতো, তাহলে হয়তো আর কখনো তাকে দেখতে হতো না। ফলে যৌনতাবিষয়ক সবকিছুকে তোমার এত ভয়াবহ লাগত না। বিষয়টি যেহেতু সুস্থ ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে আমাদের কৈশোরে পৌঁছানোর আগেই শেখানো হয় না, তাই অনেক ধরনের ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে আমরা বেড়ে উঠি। গবেষণায় পাওয়া যায়, বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর আগেই শিশুদের যদি পর্নোগ্রাফি–জাতীয় কিছুর সম্মুখীন করা হয়, তাহলে তারা সেগুলো দেখার পর হয় অপরাধবোধে ভোগে, নাহলে নিজেকে নিয়ে অনেক বেশি লজ্জা বোধ করতে থাকে। ছবিগুলোর বিষয়বস্তু অনেক সময় মনে স্থায়ী একটি ছবি তৈরি করে রাখতে পারে, যা সে না চাইলেও মাঝেমধ্যেই দেখতে পায়।

আরও পড়ুন

আমার পক্ষ থেকে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলব। যেমন শৈশবের অভিজ্ঞতাটি যখনই তোমার মাথায় আসবে, সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেলতে থাকবে। প্রতিদিন নিয়ম করে শ্বাসপ্রশ্বাসের এই ব্যায়াম করবে। তোমার যে অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে, সেগুলোর ওপর আস্থা রাখবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট কোনো একটি শরীরচর্চা করবে। জীবনে যেসব আশীর্বাদ রয়েছে, সেগুলো নিজেকে মনে করিয়ে দেবে। এই কষ্ট থেকে ভালোভাবে বেরিয়ে আসার জন্য সুদক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ভালো একজন সাইকোথেরাপিস্টের সহায়তা নেওয়ারও তোমার প্রয়োজন রয়েছে।

তুমি একটি ভালোবাসার সম্পর্কে রয়েছ। মূল্যবান এই সম্পর্ককে আরও অর্থবহ করার জন্য ভেতরের ট্রমাটি মোকাবিলা করা খুব প্রয়োজন। যেহেতু মানুষটি তোমার কৈশোরের বিষয়টি জানে না, তাই তোমার আড়ষ্ট হয়ে থাকার ব্যাপারটি নিয়ে মনে মনে যা–ই ভাবুক না কেন, মুখে সেটি প্রকাশ করছে না। তবে পরে সে এই আচরণের ব্যাখ্যা চাইতে পারে, অধিকারবোধের অনুভূতির জায়গা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পাঁচতলা ও চারতলায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র রয়েছে। তুমি সেখানে গিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নাও। জানি না, মা-বাবাকে তুমি এই বর্তমান চ্যালেঞ্জের কথাটি বলেছ কি না। অন্তত মাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি জানাও। তোমার এই ব্যাপারে তাঁর সহায়তা যে অত্যন্ত প্রয়োজন, সেটিও তাঁকে অবগত করো।

আরও পড়ুন

লেখা পাঠাবেন যেভাবে

পাঠকের প্রশ্ন পাঠানো যাবে ই–মেইলে, ডাকে এবং প্র অধুনার ফেসবুক পেজের ইনবক্সে। ই–মেইল ঠিকানা: [email protected] (সাবজেক্ট হিসেবে লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ডাক ঠিকানা: প্র অধুনা, প্রথম আলো, ১৯ কারওয়ান বাজার, ঢাকা ১২১৫। (খামের ওপর লিখুন ‘পাঠকের প্রশ্ন’) ফেসবুক পেজ: fb.com/Adhuna.PA