টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগের টিকা কেন ও কখন নেবেন
ময়লা কিছু দিয়ে সামান্য কেটে গেলে টিটেনাসের ভয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন অনেকে। ইনজেকশন নেব নাকি নেব না—পড়েন এই দ্বিধায়। কোনো কিছু চিন্তা না করেই টিকা নিয়ে নেন অনেকে। কেউ আবার টিকা নিতেই চান না। কিন্তু কখন নিতে হবে টিটেনাসের টিকা? জরুরি এই প্রশ্নের উত্তরসহ টিটেনাস নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও চিকিৎসক কাকলী হালদার।
শরীরের সামান্য ক্ষতস্থান দিয়েও প্রবেশ করতে পারে টিটেনাস বা ধনুষ্টংকারের জীবাণু। এরপর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো শরীরে। অকেজো করে দেয় শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ। রোগী ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর টিটেনাসে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আক্রান্ত ১০০ জনের মধ্যে ৩০ জনই মৃত্যুবরণ করে। তবে বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এই হার আরও বেশি, ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। তাই এ রোগের ব্যাপারে সাবধানতা জরুরি।
টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার কী?
টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার একটি গুরুতর প্রাণঘাতী রোগ। এ রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর নাম ক্লস্ট্রিডিয়াম টেটানি। এই জীবাণু শরীরের কাটা বা ক্ষত দিয়ে প্রবেশ করে শরীরের স্নায়ুতন্ত্রে বিষক্রিয়া ঘটায়। এতে মাংসপেশি প্রচণ্ড শক্ত হয়ে যায়, খিঁচুনি হয়, চোয়াল শক্ত হয়ে আটকে যায়। এ অবস্থাকে বলা হয় ‘লক জ’। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে এ রোগে জীবননাশ হতে পারে।
লক্ষণ
শরীরে টিটেনাসের লক্ষণ প্রকাশিত হওয়ার গড় সময় ১০ দিন। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে সেটি ৩ থেকে ২১ দিন হতে পারে। এ সময়কালকে বলা হয় ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’। আক্রান্ত হওয়ার পর লক্ষণগুলো শুরুতে কম প্রকাশ পেলেও দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। চোয়াল থেকে অসুস্থতা শুরু হয়ে শরীরের নিচের দিকে নামতে থাকে।
প্রাথমিক লক্ষণগুলো
চোয়ালে ব্যথা, পেশির খিঁচুনি ও পেশি অনমনীয় হয়ে ওঠে।
ঠোঁটের চারপাশে পেশিগুলো আপনা–আপনি টান খায়, কখনো কখনো রোগীর অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
ঘাড়, পিঠ, পেটের পেশিতে ব্যথাময় খিঁচুনি ও অনমনীয়তা দেখা দেয়।
খাবার গিলতে অসুবিধা হয়।
শ্বাসকষ্ট হয়।
সময়মতো চিকিৎসা না নিলে রোগের লক্ষণ বাড়তে থাকে। তখন আরও বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন—
উচ্চ রক্তচাপ
নিম্ন রক্তচাপ
দ্রুত হৃৎস্পন্দন
জ্বর
অতিরিক্ত ঘাম
টিকা বনাম বুস্টার ডোজ
টিটেনাসের প্রতিরোধে দুই ধরনের ইনজেকশন দেওয়া হয়। একটি হচ্ছে টিকা, আরেকটি বুস্টার ডোজ। দুটির কাজ ভিন্ন। একটি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করে, অন্যটির কাজ প্রতিকার করা।
টিকা বা ভ্যাকসিন
জন্মের পর শিশুকে টিডিএপি বা টিটেনাস, ডিপথেরিয়া ও পার্টুসিস—এই তিনটি রোগ প্রতিরোধকারী টিকা দেওয়া হয়। এরপর প্রতি ১০ বছরে একটি টিকা নেওয়া থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে টিটেনাসের জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
বুস্টার ডোজ বা টিআইজি
আঘাত পাওয়ার পর টিটেনাসের আশঙ্কা থাকলে বা টিটেনাসের লক্ষণ দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে একটি ইনজেকশন দেওয়া হয়। এটি টিটেনাস ইমিউনো গ্লোবিউলিন (টিআইজি) বা বুস্টার ডোজ।
আঘাতের কারণে টিটেনাস হওয়ার ঝুঁকি থাকলে এবং টিকা দেওয়া না থাকলে তাৎক্ষণিক বুস্টার ডোজ নিতে হয়।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীকে টিটেনাসের টিকা আর বুস্টার ডোজ দুটোই একসঙ্গে দেওয়া হয়।
কখন মৃত্যুঝুঁকি থাকে
গুরুতর টিটেনাসে পেশির খিঁচুনি এতটাই তীব্র হয় যে শ্বাসপ্রশ্বাস কঠিন হয়ে পড়ে এবং হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দ্রুত চিকিৎসা না নিলে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে।
কিছু ক্ষেত্রে এ রোগ শরীরের অন্যান্য অংশে, যেমন হৃৎপিণ্ড, রক্তচাপ ও মস্তিষ্কের গুরুত্বপূর্ণ অংশে প্রভাব ফেলতে পারে। আর এটা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। তবে টিটেনাস হলেই মৃত্যু অনিবার্য নয়। কিন্তু এটি মারাত্মক হতে পারে এবং দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা না নিলে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে।
বাঁচার উপায়
টিটেনাসের প্রধান চিকিৎসা হলো টিকা। গুরুতর বা অল্প আঘাতপ্রাপ্ত ক্ষতস্থানে ধুলা–ময়লা লাগলে, পুরোনো মরিচা ধরা কোনো বস্তু দিয়ে কেটে গেলে, পেরেক ঢুকে গেলে, ময়লা কোনো বস্তু দিয়ে কেটে গেলে রোগীর টিটেনাস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব ক্ষেত্রে রোগীকে একটি টিটেনাসের টিকা নিতে হবে।
পাঁচ বছরে ধনুষ্টংকারের একটি টিকাও নেওয়া না থাকলে এবং এ রোগের আশঙ্কা থাকলে একটি বুস্টার ডোজ নিতে হবে।
গর্ভাবস্থায় টিটেনাসের একটি টিকা নিতে হবে। এতে গর্ভের শিশু টিটেনাস থেকে সুরক্ষা পাবে।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) রুটিন অনুযায়ী শিশুকে ধারাবাহিকভাবে ধনুষ্টংকারের টিকা দিতে হবে। শিশু জন্মের ৬ সপ্তাহ, ১০ সপ্তাহ এবং ১৪ সপ্তাহে তিনটি টিকা দেওয়া হলে শরীরের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।
ধনুষ্টংকার রোধে ১০ বছর পরপর একটি টিকা নিতে পারেন।
টিটেনাসের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।