করোনায় ফুসফুসের শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলা সেই মানুষটাই যেভাবে হলেন পর্বতারোহী

করোনায় ফুসফুসের শক্তিই প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। আগের দম ফিরে পেতে শুরু করলেন হাঁটাহাঁটি, ম্যারাথন আর সাঁতার। সেই মানুষটাই এবার সাত মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু সাত পর্বতে ওঠার অভিযানে নেমেছেন। তারই অংশ হিসেবে জুনে মাউন্ট কিলিমানজারো জয় করে এলেন। সজীব মিয়াকে পর্বতারোহী হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন ফ্যাশন ডিজাইনার প্রবাল বর্মন

পর্বতারোহী প্রবাল বর্মনছবি: প্রবাল বর্মনের সৌজন্যে

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছিল তখন। বনানীর একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি। লকডাউনের মধ্যেই অফিসে যাই। এই করতে গিয়ে আমার শরীরে করোনা হানা দিল। কয়েক দিন রুমে বন্দী থাকলাম। আমার সেবা করতে গিয়ে মা–ও করোনা পজিটিভ হলেন। শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলাম। অবস্থা খারাপ হতে থাকলে ২০২১ সালের ২৭ মার্চ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হলাম। মাকেও আমার সঙ্গে ভর্তি করানো হলো।

প্রতিদিনই ওয়ার্ডের কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। আমি একেবারেই শ্বাস নিতে পারছিলাম না। দিন–রাত অক্সিজেন সাপোর্টে থাকি। তিন-চার দিন পর টেস্ট করে দেখা গেল আমার ফুসফুসের ৮০ শতাংশই সংক্রমিত হয়েছে। ভয় পেয়ে গেলাম। হাসপাতালের ২৪ ঘণ্টাকে মনে হচ্ছিল ২৪ দিন। মাথায় সব সময় মৃত্যুচিন্তা—জীবনে কী করতে পারতাম, কী করিনি। একদিন মনে পড়ে গেল ২০০৭ সালের একটা প্রতিজ্ঞার কথা। মজা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের বলেছিলাম, ২০২০ সালের মধ্যে এভারেস্ট অভিযানে যাব। কিন্তু পড়াশোনা, চাকরি আর সংসারের দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ায় সে পথে আর হাঁটাই হয়নি।

হাসপাতালে ভর্তির সপ্তম কি অষ্টম দিনে আবার শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ হলো। মাকে একপাশে ডেকে নিয়ে ডাক্তার যখন বলল, তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন, কথাটা তখন আমার কানেও এল। দেখলাম, কথাটা শুনে মা ভেঙে পড়েছেন। তারপরও আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘তোর কিছু হবে না।’

আমিও মাকে বললাম, ‘হ্যাঁ মা, আমাকে বাড়ি যেতেই হবে।’

মনে মনে সারাটা সময় নিজেকে আবিষ্কার করতাম কোন পাহাড়চূড়ায়, ঝিরিপথে। নিজে নিজেই নতুন করে বাঁচার জন্য পণ করতাম। এভাবেই নবমতম দিনে একটু ভালো বোধ করলাম। মনের জোর এতটাই বৃদ্ধি পেল যে সকালে মাকে বললাম, আমার অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দাও!

মা ভয়ে ভয়ে খুললেন। অক্সিজেন ছাড়াও আর অসুবিধা হলো না।

১১ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে মনে হচ্ছিল, নতুন জীবন নিয়ে বাসায় ফিরছি।

প্রতিজ্ঞা করলাম, এই জীবনকে আর হেলায় হারাব না।

বান্দরবানের গহিন পাহাড়ে
ছবি: প্রবাল বর্মনের সৌজন্যে

হেঁটে বনানী টু কেরানীগঞ্জ

বাসায় ফিরে কোয়ারেন্টিনে কাটল সপ্তাহখানেক। শরীরে মোটেও শক্তি পাই না। তার মধ্যেই করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে অফিস শুরু করলাম। কিন্তু দুই কদম হাঁটলেও দুর্বল লাগে। প্রতিদিন হাঁটাহাঁটি করার পরামর্শ দিলেন ডাক্তার। শুরুও করলাম। এভাবে দুই মাস যাওয়ার পর শরীরের ওপর আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু হলো। জিম শুরু করলে অনেকটাই স্বাভাবিক হতে শুরু করল শরীরের অবস্থা।

একদিন ভাবলাম, অফিস থেকে হেঁটেই বাসায় যাব। বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি থেকে কেরানীগঞ্জ প্রায় ১২ কিলোমিটার। অনায়াসেই চলে গেলাম। তখন ভাবলাম, অফিসে আসা-যাওয়া হেঁটেই করব। এভাবে প্রায় তিন মাস চলল। করোনা–পরবর্তী যেসব সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তার মধ্যে চোখ আর শরীরের সমস্যাগুলো প্রায় ভালো হয়ে গেল।

পাহাড়ের কথা তখনো মনে মনে ভাবছি। কোথায় যাব, কীভাবে যাব, চিন্তা করছি। লকডাউনে বন্ধ পর্যটন স্থান আস্তে আস্তে খুলতে থাকল। আমিও বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে কেওক্রাডং, তাজিংডং, সাকা হাফংয়ের মতো উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোয় ঘুরতে থাকলাম। অথচ দুর্গম এসব এলাকায় যাওয়ার আগে পাহাড়ে চড়ার কোনো অভিজ্ঞতাই আমার ছিল না।

টেকনাফ থেকে হেঁটে হেঁটে তেঁতুলিয়ায়
ছবি: প্রবাল বর্মনের সৌজন্যে

একদিন হঠাৎ ফেসবুকে মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাতকে নিয়ে প্রথম আলোর একটা ডকুমেন্টারি সামনে এল। দৌড়ে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া গেছেন তিনি। মনে মনে ভাবলাম, দৌড়ে না পারি, হেঁটে তো দেশের একমাথা থেকে আরেক মাথায় যেতে পারি।

কিন্তু অফিস সামলে কীভাবে যাব?

সপ্তাহে দুই দিন মাত্র ছুটি। সেই দুই দিন করে গিয়েই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এভাবে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর শুরু করে পরের ২১ ফেব্রুয়ারি অভিযানটা শেষ করি। লেগেছিল ১৭ দিন।

ম্যারাথনের আয়োজনে
ছবি: প্রবাল বর্মনের সৌজন্যে

সাত শৃঙ্গ ছোঁয়ার স্বপ্ন

পাহাড়ে যাওয়া আর হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে নতুন নতুন রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের সঙ্গে পরিচয় হতে থাকল। তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন ম্যারাথনে অংশ নিতে থাকলাম। ভারতে গিয়েও ম্যারাথনে অংশ নিলাম।

এর মধ্যেই একদিন নেপালের নির্মল পুরজার নাম শুনলাম। মাত্র সাত মাসের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পর্বতশৃঙ্গে উড়িয়েছেন বিজয় নিশান। সেই অভিযানের ডকুমেন্টারি পর্বতের প্রতি আমার ভালোবাসা হাজার গুণ বাড়িয়ে দিল। আর সাহস জোগাল টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পায়ে হাঁটার দিনগুলো। এই অনুপ্রেরণা আর সাহস নিয়েই এভারেস্ট বেজক্যাম্প অভিযানে গেলাম ২০২৩ সালের এপ্রিলে। ১৪ দিনের অভিযানে জীবন আমার বদলে গেল। বরফঢাকা পর্বতের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হলো। কিন্তু চাইলেই তো সব ছেড়েছুড়ে যেতে পারি না। স্ত্রী-সন্তান, পরিবার, চাকরি—সব সামলে সময় বের করতে হয়।

বুড়িগঙ্গার তীরে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় নদীতে দাপাদাপির স্মৃতি বিস্তর। সেই ভরসাতেই বাংলা চ্যানেলে সাঁতার কাটার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু মুশকিল হলো দীর্ঘদিন তো পানিতে নামা হয়নি। পারব তো? শুরু হলো সাঁতারের চেষ্টা। দম ধরে রেখে সাঁতার কাটা যে কী কষ্ট, হাড়ে হাড়ে টের পেলাম গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কের পুকুরে নেমে। অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সাঁতারের কৌশলও রপ্ত করলাম। সেই কৌশলেই ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাংলা চ্যানেল (টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন) সাঁতরে পাড়ি দিলাম।

কিলিমানজারো অভিযানে সহযাত্রীর সঙ্গে
ছবি: প্রবাল বর্মনের সৌজন্যে
আরও পড়ুন

সময়ের ফেরে পড়ে পর্বতারোহণ নিয়ে কোর্স করা হচ্ছিল না। অবশেষে গত বছর ঈদুল ফিতরের ছুটিতে মিলল সময়। চলে গেলাম ভারতের উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশীতে অবস্থিত নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিংয়ে (এনআইএম)। পর্বতারোহণের ওপর ২৮ দিনের প্রাথমিক কোর্স করলাম। কোর্স শেষে করেই ভেবেছিলাম কোনো একটি পর্বতচূড়া স্পর্শ করব। পাঁচ দিনের অভিযানে গত বছর জুনে বাংলাদেশের পতাকা উড়াই ভারতের ফ্রেন্ডশিপ পিক (৫২৮৯ মিটার) নামের পর্বতের চূড়ায়।

কিলিমানজারো পর্বতের চূড়ায় প্রবাল বর্মন
ছবি: প্রবাল বর্মনের সৌজন্যে

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুস সারাতে গিয়ে অজানা এক জীবনের সন্ধান পেলাম। সেই সন্ধান করতে গিয়েই সেভেন সামিট সম্পর্কে জানি। বাংলাদেশের প্রথম পর্বতারোহী হিসেবে সাত মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ চূড়া জয় (সেভেন সামিট) করেছেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। আমিও পরিকল্পনা আঁটলাম। লক্ষ্য চার বছরের মধ্যে অভিযানটা শেষ করব। আমার সহযাত্রী হলেন চিন্ময় সাহা ও শায়লা শারমিন।

আফ্রিকার সর্বোচ্চ চূড়া তানজানিয়ার কিলিমানজারো অভিযানে তিনজনই গিয়েছিলাম। কিন্তু ২ জুন শুরু হওয়া অভিযান শায়লা শেষ করতে পারেননি। চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে বিশেষ ব্যবস্থায় পর্বত থেকে তাঁকে নিচে নামিয়ে আনা হয়। তাঁকে বিদায় জানিয়ে ৯ জুন কিলিমানজারো চূড়ায় পৌঁছাই আমি আর চিন্ময়।

আরও পড়ুন