‘না’ বলতে চেয়েও কেন আমরা ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলি

হয়তো কাজের অনেক চাপ, নতুন কোনো দায়িত্ব কাঁধে নেওয়া কঠিন হয়ে যাবে; তবু অনেক সময় কর্মক্ষেত্রে আমরা ‘না’ বলতে পারি নামডেল: সিফাত ও জুলফিকার

বিশ্বাস করুন, ‘না’ বলতে পারাটা দারুণ ব্যাপার! সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমরা এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হই, যখন আমাদের মন বলে ‘না’, কিন্তু আমরা মুখে বলি ‘হ্যাঁ’। বড় হওয়ার পরেও এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকে। অথচ ‘না’–কে ‘না’ বলতে পারলেই অনাকাঙ্ক্ষিত বহু বিষয় এড়ানো সম্ভব। সহজ এই ‘না’ শব্দটা কখনো কখনো উচ্চারণ করা এত কঠিন হয়ে দাঁড়ায় কেন, জানেন?
আমরা যখন ছোট, তখন থেকেই আমাদের শেখানো হয়, গুরুজনের অবাধ্য হতে নেই। ক্লাসে যে ছেলেটি বা মেয়েটি শিক্ষকের সব কথা শোনে, তারই প্রশংসা করা হয়। সবাই তাকে ‘ভালো’ জানে। অন্যদিকে, বড়দের কথা না শুনলে কপালে জুটতে পারে বকুনি। তাই একটি শিশু ‘বাধ্যগত’ হোক কিংবা না হোক, ‘বাধ্যগত’ হওয়াটা যে ‘ভালো’, তা তার মাথায় ঢুকে যায়। বিষয়টা কেবল মনেরই নয়। এর সঙ্গে বৈজ্ঞানিক ব্যাপারস্যাপারও জড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক সুনিতা সাহ দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে গবেষণা করছেন। ‘ডিফাই: দ্য পাওয়ার অব নো ইন আ ওয়ার্ল্ড দ্যাট ডিমান্ডস ইয়েস’ নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি।

সুনিতা সাহর মতে, আমরা যখন আনন্দে থাকি, সন্তুষ্ট থাকি কিংবা কোনো কিছুর জন্য পুরস্কৃত হই, তখন আমাদের দেহে ডোপামিনের নিঃসরণ বাড়ে। ডোপামিনকে বলা হয় সুখের হরমোন। কাউকে ‘হ্যাঁ’ বললে তিনি সন্তুষ্ট হন, আমরা হই পরিতৃপ্ত, আমাদের দেহে বাড়ে ডোপামিনের নিঃসরণ। তাই স্নায়বিক প্রক্রিয়াতেই অন্যের প্রতি আমাদের স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে গড়ে ওঠে ‘হ্যাঁ’ বলার প্রবণতা।
বড় হতে হতে ‘অবুঝ দুষ্টুমি’র মাত্রা কমে আসে। বাড়ে সামাজিক পরিসরে যোগাযোগ। তবে আমাদের স্নায়ুতন্ত্র জানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে কাউকে ‘হ্যাঁ’ বলাটাই সন্তুষ্টির পরিবেশ সৃষ্টি করবে। কাউকে ‘না’ বললে তিনি মনে আঘাত পাবেন কিংবা বিষয়টাকে খারাপভাবে নেবেন; এটা হয়তো অবিশ্বাস কিংবা অসম্মানসূচক একটা ব্যাপার হবে। সুতরাং, নিজের যত কষ্টই হোক, অন্যের অনুরোধে ‘হ্যাঁ’ বলাটাকেই আপনি নিরাপদ মনে করেন। জীবন পরিক্রমায় তো আমরা এমনটাই শিখি। এ হলো আমাদের জীবনের পাঠ। আমি যদি ‘না’ বলি, তাহলে ও কী ভাববে!—অন্যের ভাবনার তোয়াক্কা করতে গিয়েই আমরা মন না চাইলেও অনেক সময় অনেক কিছুতে রাজি হয়ে যাই।
বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলও জানাচ্ছে এমনটাই। এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের জন্য দুটি লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, যার মধ্যে একটি খুব একটা লাভজনক নয়। কিন্তু একজন ব্যক্তি ওই ‘অলাভজনক’ লটারিটিই নিতে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। ফলে সেটিই নিয়ে নেন শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ। কারণ? ‘না’ বলতে না পারা। আর যখন ওই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তাঁদের লটারি বদলানোর সুযোগ দেওয়া হলো, তখন ‘অলাভজনক’ লটারি গ্রহণের হার নেমে এল প্রায় ৫০ শতাংশে!

আরও পড়ুন

এ তো কেবল নিজের লাভ–ক্ষতির ব্যাপার। গবেষণায় এমনও দেখা গেছে, অচেনা একজন মানুষকে ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মতো ভয়াবহ কাজ করতে বলার পরেও দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ সেই অন্যায় কাজটা করতেই রাজি হয়ে গেছেন! যদিও তাঁদের অনেককে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কাজটা করতে গিয়ে তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তবু ন্যায়-অন্যায়ের দোলাচলে তাঁরা অন্যায়ের পথটাই বেছে নিতে রাজি হয়েছেন কেবল অন্যকে ‘না’ বলতে না পেরে।
প্রাত্যহিক জীবনে এভাবে বহু মানুষকে ‘হ্যাঁ’ বলার পরে সেই ‘হ্যাঁ’ রক্ষা করতে গিয়ে কখনো কখনো আমরা ভীষণ চাপে পড়ে যাই। তবু ‘মুখরক্ষা’র জন্য ‘হ্যাঁ’ বলেই চলি। আবার কেউ কেউ এমন কোনো পরিস্থিতিতেও পড়তে পারেন, যখন আত্মবিশ্বাসের অভাবে তিনি ‘হ্যাঁ’ বলে ফেলছেন। মুখ ফুটে ‘না’ শব্দটি বলার সাহস পাচ্ছেন না। মোট কথা, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, ‘হ্যাঁ’ বলাটাই হয়ে দাঁড়ায় ‘সহজ ব্যাপার’।
অথচ ব্যক্তিজীবনে নিজের ভালো থাকার জন্য সঠিক সময়ে ‘না’ বলতে পারা খুবই জরুরি। কঠোরতা না দেখিয়েও আপনি সুন্দরভাবে ‘না’ করতে পারেন যে কাউকেই। তিনি আপনার জীবনসঙ্গী, অভিভাবক, অফিসকর্তা, সহকর্মী—যে-ই হোন না কেন। সবার জন্যই জীবনে একটা সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিন চমৎকারভাবে। তাহলে অকারণ চাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন সহজে। তবে হ্যাঁ, কোমলভাবে ‘না’ বলতে পারাটা একটা শিল্প বটে!


সূত্র: টাইম ডটকম

আরও পড়ুন