মায়ের দেওয়া ডানায় উড়ে যেভাবে একা যুক্তরাষ্ট্রে এলাম
সমাবর্তনের দিনটা আরও বিশেষ হয়ে ওঠে, যদি সঙ্গে থাকেন মা-বাবা। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছবি তুলতে গিয়ে হয়তো সিনেমার মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফেলে আসা দিনগুলো। আজ মা দিবসে সেসব দিনের স্মৃতিচারণা নিয়ে সন্তানদের লেখা প্রকাশিত হয়েছে স্বপ্ন নিয়ে পাতায়। এখানে পড়ুন যুক্তরাষ্ট্রের হেক্সাগন অ্যাসেট লাইফসাইকেল অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্সের সফটওয়্যার প্রকৌশলী আশরাফ ঐন্দ্রীর লেখা।
আমার মা একজন গৃহিণী। কম বয়সে তাঁর বিয়ে হয়েছিল, তার পরপরই আমাদের আগমন। পারিবারিক, আর্থিক, সামাজিক হাজারো জালে বহু আগেই মায়ের নিজের স্বপ্নগুলো সিন্দুকে তালাবদ্ধ হয়ে গেছে। অসম্পূর্ণ সেই সব স্বপ্নের ছায়াই তাঁর দুই মেয়ের মধ্যে খুঁজেছেন তিনি। সব বাধা–বিপত্তি পেরিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন মা।
১৬-১৭ বছর বয়সী বাচ্চা মেয়েকে এই দূর ভিনদেশে পাঠিয়ে দিতে মায়ের একটুও বুক কাঁপেনি। সবাই বলত, ‘ও তো মেয়ে, ওকে মাস্টার্সের আগে বা বিয়ে না দিয়ে বিদেশে যেতে দিয়ো না। জামাই নিয়ে যাবে।’ বুকে অদম্য সাহস নিয়ে আমার মা বলতেন, ‘না ও পারবে।’ এমন একটা সমাজ, শহর বা পরিবেশ থেকে মা আমাদের তুলে এনে বিশ্বমঞ্চে দাঁড় করিয়েছেন, যেটা হয়তো আজও অনেক মেয়ের জন্য অকল্পনীয়। আমাদের সমাজ বলে, মেয়েরা শিক্ষিত হবে ঠিক আছে, কিন্তু তাদের লাগাম বা ‘লিমিট’ থাকবে। বেশি স্বাবলম্বী বা উচ্চশিক্ষিত মেয়েরা হয় অহংকারী। কথা কম বলতে হবে, মুচকি হাসতে হবে। তর্ক করা যাবে না, সব মেনে নেওয়া শিখতে হবে। এমন এক পরিবেশে এই মা আমাদের একেবারে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস জুগিয়েছেন, নিজের অধিকারের জন্য দুর্গম দুর্গের মতো দাঁড়িয়ে থাকার উৎসাহ দিয়েছেন। সমাজের কথায় কান না দিয়ে যেটা অর্জন করতে চাই, সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার শুধু অনুপ্রেরণাই নয়, রীতিমতো ‘প্রশিক্ষণ’ দিয়েছেন সেই ছোট্ট বয়স থেকে।
যখন ছোট ছিলাম, মায়ের ওপর খুব রাগ হতো। কেন আমাকে এই ভোর পাঁচটায় উঠে আরেক শহরে গিয়ে নতুন কুঁড়ি বা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে হবে! আর দশজন সহপাঠীর মতো আমিও তো সিলেবাসের পড়াটা শেষ করে একটুখানি খেলাধুলার সময় পাই। কী পচা আমার আম্মুটা, ভেবে খুব রাগ হতো। তা-ও মায়ের একটাই কথা—ভয় পেলে সমস্যা নেই, একবার মঞ্চে উঠে দুইটা লাইন হলেও গেয়ে নামতে হবে। সেই শুরু। গান থেকে নাচ, কুইজ, বিতর্ক, অলিম্পিয়াড—এমন কিছু নেই, যেখানে আমার অংশ নেওয়ার পেছনে মায়ের হাত নেই। যেখানেই যাই, আমার আগে সবাই মাকে চিনত। বলত, ঐন্দ্রীর আম্মু। আর তাতেই মায়ের কী গর্ব!
তখন বুঝিনি, মা আসলে আমার আকাশে ওড়ার ডানা তৈরি করছেন। পরীক্ষার আগে যত রাতই হোক, পাশে বসে যেন আমার মতোই পড়তেন। নাচের স্টেপ, গানের কথা, সব ছিল তাঁর মুখস্থ। কখন কী ভুল করলাম, সব তাঁর জানা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যালাবামা থেকে কম্পিউটার প্রকৌশলে আমার স্নাতক শেষ হয় ২০২২ সালে। ক্লাসের সেরা ছাত্রছাত্রীর একজন হিসেবে আমাকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে যখনই সময় পেতাম, কোনো ক্লাব বা সংস্থার হয়ে কাজ করতাম। ২০২০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ‘স্টুডেন্ট গভর্নমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘ডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স পরিচালক’ পদের জন্য ভোট হয়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলাম। সোসাইটি অব ওম্যান ইঞ্জিনিয়ারের অ্যালাবামা শাখায় বোর্ড সদস্য হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগও হয়েছিল। কে জানত, যশোরের ছোট্ট শহরের এক গৃহিণীর প্রচেষ্টায় তাঁর মেয়ে এত দূর পৌঁছাবে!