‘কেয়ার অব ডক্টর মিতু’ ফেসবুক গ্রুপ খোলার পেছনের গল্প বললেন মাহমুদা মিতু

পেশায় স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক মাহমুদা আলম
ছবি: সংগৃহীত

সাড়ে তিন বছরের সন্তানের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা লিখে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন এক মা। সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন ওষুধের প্যাকেটের ছবি। ফার্মেসির লোকের পরামর্শে ওষুধটা কিনে সন্তানকে খাইয়েছেন। পোস্টটি পড়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন মাহমুদা আলম। এতটুকুন শিশুকে না জেনে এভাবে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো উচিত না, এতে কী ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, কমেন্টে সে কথা লিখে জানান তিনি। সেই সঙ্গে ফার্মেসির লোকের ওপর রাগে–ক্ষোভে পুলিশকেও বিষয়টি অবহিত করেন। এটুকু করেই দায়িত্ব শেষ করেননি এই চিকিৎসক। ভাবলেন, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে ফেসবুকে মানুষকে সচেতন করতে হবে। সেই প্রয়াস থেকে খুললেন ফেসবুক গ্রুপ—‘কেয়ার অব ডক্টর মিতু’। পেশায় স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের চিকিৎসক মাহমুদা আলম গ্রুপের সবার কাছে মাহমুদা মিতু।

মিতুর গ্রুপে ঢুঁ মেরে দেখা গেল, একটি পোস্টের জবাবে তিনি জানাচ্ছেন, ‘আপনার সব রিপোর্ট নরমাল (স্বাভাবিক) মানেই আপনার নরমাল ডেলিভারি (স্বাভাবিক প্রসব) হবে, ব্যাপারটা তেমন না। এর সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ে জরায়ুর মুখ খোলার সম্পর্কটাও অনেক বেশি। প্রেশার (রক্তচাপ), ডায়াবেটিস, ওজন, উচ্চতা, কোমরের হাড়ের মাপ ও অন্যান্য অনেক ফ্যাক্টর তো আছেই।’ এর পর করণীয় নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। রোগীর ভুল ধারণাগুলো দূর করার জন্য লেখাগুলো পড়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘আপনার ডক্টর (চিকিৎসক) আপনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই রোগীর ক্ষতি হোক, এমন কিছু চান না।’ এরপর মাসিক ও গর্ভধারণ নিয়ে কিছু তথ্য জানিয়েছেন তিনি। কিছু কথা লিখেছেন বেশ রসিয়ে, কৌতূহলোদ্দীপক করে। আবার কোনো পোস্টে আছে হাসপাতালের প্রসবকক্ষে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে কোলে নিয়ে হাসছেন মিতু।

মাহমুদা মিতু
ছবি: সাজিদ হোসেন

মাহমুদা মিতু জানান, ২০২১ সালে খোলা গ্রুপটির সদস্য ছিলেন ৬৮ হাজার। রেস্ট্রিকশনের কারণে কেয়ার অব ডক্টর মিতু নামেই গত অক্টোবরে নতুন যে গ্রুপ খুলেছেন, তার সদস্য এখন ২৮ হাজারের বেশি। এই গ্রুপের সদস্যরা সবাই নারী। একই নামে আরেকটি পাবলিক গ্রুপ আছে। যেটাতে নারী–পুরুষ মিলে সদস্য ১৮ হাজার।

মাহমুদা মিতু বলেন, ‘এই গ্রুপগুলোতে অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, যাঁদের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি। কারও কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে। তাঁরা এতটাই ভালোবাসা প্রকাশ করেন যে মনে হয়, এই জীবনে আর কিছুই পাওয়ার নেই। এই গ্রুপে বিনা মূল্যে সেবা দেওয়া হয়। আমার শুধু মনে হয়, অর্থের সম্পর্ক রাখলে মানুষের হয়তো আমার ওপর আস্থা থাকবে না।’

আন্দোলন ও রাজনীতিতে সক্রিয়

জুলাইয়ের উত্তাল আন্দোলনের সময় আজিমপুরের মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (আজিমপুর ম্যাটারনিটি নামে পরিচিত) পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে কাজ করছিলেন মাহমুদা মিতু। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে বাড্ডা এলাকায় আন্দোলনে ঢুকে পড়তেন। বললেন, ‘আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বিচার মানুষ হত্যার ভিডিও দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। এত এত বাচ্চা মারা গেল! এরপর আর ঘরে থাকা যায় না।’

মিতু জানান, ১৪৪ ধারা জারির সময় রাস্তায় আন্দোলনে ছিলেন তিনি। তাঁর চোখের সামনে একটা কম বয়সী ছেলে গুলিতে মারা যায়। হোয়াটসঅ্যাপে ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম নামে চিকিৎসকদের একটি গ্রুপ খোলা হয়। এই গ্রুপের মাধ্যমে আহত মানুষদের তাঁরা ফোনে পরামর্শ দিতেন। মাহমুদা নিজে আন্দোলনে আহত ৩০০ জনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। পাশাপাশি নিজের গ্রুপ থেকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের পরামর্শ দিতেন। অস্থিতিশীল অবস্থার কারণে হাসপাতালে যেতে পারছেন না বলে জানাতেন অনেক নারী। কথা বলার এক পর্যায়ে মাহমুদা বললেন, ‘এসব ঘটনা কখনো গল্প হবে ভাবিনি।’

হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের সময় মাহমুদা মিতুর ডাক পড়ে। তিনি এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের নতুন এই রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি। নতুন দলের আত্মপ্রকাশের আগে তিনি ছিলেন জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব। তিনি কমিটির শহীদ ও আহত কল্যাণ সেলের সম্পাদকও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘নিজের ইচ্ছায় রাজনীতিতে আসিনি। চলে আসা হয়েছে। যদিও দাদা আমজাদ হোসেন স্বপ্ন বুনে গিয়েছিলেন।’ ২২ বছর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর দাদা। তিনি বলতেন, ‘তোমরা কেউ একজন আমার জায়গা নেবে।’

মাহমুদা মিতু এখন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের যুগ্ম মুখ্য সংগঠক
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন

মাহবুব আলম ও ইয়াসমীন আলম দম্পতির দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মাহমুদা বড়। উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর ২০০৯ সালে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। মেডিকেলে ভর্তির সময় তিনি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তিনি শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৭ সালে এমবিবিএস পাস করেন। ঝালকাঠির মেয়ে মাহমুদা বলেন, শাশুড়ি শিক্ষক আলিমুন্নেসার অনুপ্রেরণায় তিনি মেডিকেলে পড়তে পেরেছেন। আর মায়ের সমর্থনে পেশা ও রাজনীতি নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারছেন। স্বামী মাহবুবুর রহমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। তাঁদের দুই সন্তান। সংগঠকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মাহমুদা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবদ্যা বিভাগে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রশিক্ষণার্থী।

আন্দোলন–রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার পর থেকে অপর পক্ষের কাদা–ছোড়াছুড়ি ও সাইবার হয়রানির শিকার হচ্ছেন মাহমুদা মিতু, ‘আমি খুব লড়াই করছি। পরিস্থিতি এমন, ভালো কাজ করলেও কেউ কেউ সন্দেহের চোখে দেখে। বলে, ভাইরাল হতে চায়।’

সরলতা দিয়ে রাজনীতি করতে চান মাহমুদা। তাঁর ভাষায়, ‘একদিন এই সরলতা ও সততাই রাজনীতিতে আমার সম্পদ হবে। সরলতা–সততার জন্যই মানুষ আমাকে ভালোবাসবে।’