পলিটেকনিকের ছাত্র খালেদ যেভাবে গুগলে
কুমিল্লা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে তড়িৎ প্রকৌশলে ডিপ্লোমা করেন খালেদ বিন সাইফুল্লাহ। তারপর ভর্তি হন ঢাকার উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে। ২০১৭ সালে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে স্নাতক করেন। পরের বছরই যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এই প্রকৌশলী। সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রকল্প ভিত্তিতে কাজ করেছেন। এর মধ্যে ওয়েলস ফার্গো, জনসন অ্যান্ড জনসন, সিগনাও আছে। আর ২০২২ সাল থেকে আছেন বিখ্যাত প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান গুগলে। কীভাবে নিজেকে তৈরি করেছেন এই প্রকৌশলী?
বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ
এক যুগ আগের কথা। ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীরা তখন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট) ছাড়া আর অল্প কিছু বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতকে পড়তে পারতেন। উত্তরা ইউনিভার্সিটি ছিল তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ বেশি। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় ভর্তির আগে তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল নানা দুশ্চিন্তা। উত্তরা ইউনিভার্সিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খালেদ বলেন, ‘আমরা যখন ডিপ্লোমা করেছি, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে জেনেছি, প্রয়োজনীয় অনেক দক্ষতা শিখেছি। এই যেমন প্রেজেন্টেশন স্কিল, কীভাবে পাওয়ার পয়েন্টে কাজ করতে হয় ইত্যাদি। এসবের জন্য অবশ্যই ভার্সিটিকে ধন্যবাদ দিতে চাই। উত্তরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার খরচ আমার সামর্থ্যের মধ্যে ছিল। সেটাও পড়ালেখা এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে।’
সন্ধ্যাকালীন শিফটে ক্লাস হতো। এর বাইরে বড় একটা সময় লাইব্রেরিতে কাটাতেন খালেদ। পাশের ক্যানটিনেও জমত আড্ডা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, ‘লাইব্রেরিটা আমি মিস করি। ক্লাসে যা পড়ানো হতো, সেসব বিষয়ের বই থাকত সেখানে। পড়াশোনা করতাম, নোট নিতাম। গ্রুপ স্টাডিও করতাম। এ সময়ে যোগাযোগের দক্ষতা গড়ে উঠেছে।’
আট বছর পর নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পরিবর্তন এই তরুণের চোখে পড়েছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কার্যক্রম দেখে তাঁর ভালো লাগে, জানালেন তা-ও।
স্বশিক্ষায় সাফল্য
ডিপ্লোমায় পড়েছেন তড়িৎ প্রকৌশল। কিন্তু খালেদের ভালো লাগত কম্পিউটারবিজ্ঞানের (সিএসই) নানা বিষয়। সৌভাগ্যক্রমে তার রুমমেট ছিলেন সিএসইর ছাত্র। ওই সুবাদে বন্ধুর বইয়ে টুকটাক চোখ বোলাতেন। তখনই প্রোগ্রামিংয়ের শুরু। অবশ্য কোডিংয়ের প্রতি আকর্ষণ ছিল আরও আগে থেকেই।
খালেদ বলেন, ‘ক্লাস থাকত সন্ধ্যায়। অন্য সময় ফ্রি থাকতাম। দিনের বেলায় প্রোগ্রামিং বা সিএসই–সংক্রান্ত বই পড়েছি। ইউটিউবে ভিডিও দেখেও চেষ্টা করতাম। ওই সময় ইন্টারনেট ছিল ব্যয়বহুল। তাই ক্যাম্পাসের ওয়াইফাই দিয়ে বিভিন্ন রিসোর্স ডাউনলোড করে বাসায় এসে শিখতাম।’
যা কেবল নিজের আগ্রহ থেকে শিখেছেন, সে বিষয়েই এখন ক্যারিয়ার গড়েছেন গুগলের মতো প্রতিষ্ঠানে। খালেদের বক্তব্য, ‘যা ভালোবাসি, সেটা নিয়ে কাজ করে সফলতা এলে আনন্দ আরও বেড়ে যায়।’ তাই বলে কিন্তু তড়িৎ প্রকৌশলের পড়ায় ফাঁকি দেননি এই তরুণ। বুঝে বুঝে পড়েছেন। বড় ভাইদের, ওয়েবসাইটের সাহায্য নিয়েছেন। সফটওয়্যারের কাজ করলেও স্নাতকের মৌলিক জ্ঞান তাঁর পেশাজীবনে কাজে লেগেছে।
গুগলে চাকরি
‘গুগল ওয়ালেট’ দলে ‘টেস্ট ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে কাজ করছেন খালেদ। গুগলের নতুন নতুন ফিচার তৈরি ও টেস্ট করাই তাঁর প্রধান কাজ। শুরুর দিকে ছিলেন ‘গুগল ফটোজ’ দলেও।
কিন্তু গুগলে চাকরি পাওয়ার পথটা কেমন ছিল? খালেদ বলেন, ‘বিদেশে আসার পর অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। কীভাবে চাকরির বাজারে ঢুকতে হয়, সে বিষয়ে ধারণা ছিল না। নিজে নিজে শেখার চেষ্টা করেছি। আসলে মাঠে কাজ করতে গেলেই চ্যালেঞ্জ বোঝা যায়।’
এক শিক্ষকের নির্দেশনায় ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছেন খালেদ। এসব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেই একসময় গুগলে চাকরি পান।
ব্যর্থতা যত আসবে, সাফল্য তত কাছে
গুগলে কাজের পরিবেশ বেশ উপভোগ করেন খালেদ। তাঁর মতে, ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে কাজের সঠিক ভারসাম্য কত সুন্দর হতে পারে, সেটা তিনি গুগলে গিয়েই অনুভব করেছেন। নিজে থেকেই অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা এখানে বেশি।
খারাপ সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতার কথাও বললেন খালেদ, ‘এমনও হয়েছে, অনেক ভালো ইন্টারভিউ দিয়েছি। নিশ্চিত ছিলাম, চাকরিটা পাব। কিন্তু দিন শেষে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। তবে হতাশ না হয়ে এটা থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়েছি। পরেরটার জন্য নতুন উদ্যমে আরও বেশি পরিশ্রম করেছি। বিশ্বাস করতাম, যত ব্যর্থতা আসবে, তার মানে সফলতা তত কাছে।
বর্তমানে বছরে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ মার্কিন ডলার পর্যন্ত আয় করেন খালেদ বিন সাইফুল্লাহ।