মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী
টগরের দুই পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রেখেছিল তিন দিন
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বেশ কবছর ধরে বই আকারে প্রকাশ করছে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সংগৃহীত ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী–ভাষ্য’। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতেই তাদের এই উদ্যোগ। জাদুঘরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিক্ষার্থীরা পরিচিতজনদের সঙ্গে আলাপ করে একাত্তরের স্মৃতি লিখিতভাবে পাঠায়। ফলে এই কর্মসূচি এক অর্থে বিনিময়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইতিহাস এবং শিক্ষার্থীরা জোগান দিচ্ছে ইতিহাসের নতুন উপাদান। শিক্ষার্থীদের পাঠানো এসব ভাষ্য থেকে বাছাই ৩১টি কাহিনি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে প্রকাশ করছে প্রথম আলো।
সংগ্রহকারী: ফাহমিদা খানম, সপ্তম শ্রেণি, আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, চুয়াডাঙ্গা
বর্ণনাকারী: মোফাজ্জল হোসেন খান, পারকুলা, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা
সংগ্রহকারী ও বর্ণনাকারীর সম্পর্ক: নাতনি–দাদা
আমাদের পারকুলা গ্রামটি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কালিদাসপুর ইউনিয়নে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুমার নদ। এই নদের পাশের একটি গ্রাম সুকচা। ১৯৭১ সালে এই গ্রামে হানা দেয় পাকিস্তানি সেনারা। কাছেই ছিল মুক্তিবাহিনী। রাজাকাররা এই তথ্য পাকিস্তানি বাহিনীকে জানিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা একসময় মুক্তিবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। শুরু হয় মুখোমুখি সংঘর্ষ।
সংঘর্ষে আলমডাঙ্গার টগর নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। দিনটি ছিল ১৪ আগস্ট। পাকিস্তানি সেনারা টগরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত গুলিবর্ষণ করে। বেশ কিছু দূরে একটা মাঠে একজন বৃদ্ধ ঘাস কাটছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে ধরে এনে টগরের মৃতদেহ তাঁর কাঁধে চাপিয়ে দেয় এবং গ্রামের একটি বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য করে।
বাড়িটির ভেতর ঢুকে পাকিস্তানি সেনারা বৃদ্ধকে গরুর গাড়ি আনতে বলে। বৃদ্ধ বাড়ির ভেতর ঢুকে পালিয়ে যান। পাকিস্তানি সেনারা তাদের গাড়ির পেছনে টগরের মৃতদেহ বেঁধে সারা রাস্তা ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে আলমডাঙ্গার দিকে নিয়ে যায়।
আলমডাঙ্গার স্বর্ণকার পট্টির মোড়ে একটি লম্বা বাঁশ পুঁতে সেটির মাথায় টগরের দুই পা বেঁধে মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে রাখে তিন দিন। সেখানে একটি বাড়িতে টগরের মা-বাবা ছিলেন। তাঁদের সামনে টগরকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। কিন্তু মা-বাবা নিরুপায়। কিছুই করতে পারেননি। এমনকি নিজের সন্তান বলে পরিচয়ও দিতে পারেননি। শুধু চোখ থেকে পানি ঝরেছে।
আলমডাঙ্গার রেলসেতুর এপার-ওপারে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প। গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের ঘরের চাল খুলে এনে নিজেদের ক্যাম্পের ছাউনি বানিয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী রেললাইনের চলন্ত রেলগাড়ি থামিয়ে বেছে বেছে তরুণ-যুবকদের নামিয়ে নিত এবং তাদের ক্যাম্পে রেখে দিত।
সন্ধ্যার আগে রাজাকারদের সহযোগিতায় কুমার নদের পাশে সেসব ছেলেকে দিয়ে তাদের হাতে তাদের জন্যই গর্ত খোঁড়াত। প্রতিদিন একেকটি গর্তে ৮-১০টি লাশ একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হতো। তরুণদের মাথায় অস্ত্র দিয়ে আঘাত করত আর ফেলে দিত গর্তে। সেই জায়গাটি আলমডাঙ্গা বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
একদিন এক গর্তে ১৪ জনকে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ১৪ জনের মধ্যে এক তরুণের মাথায় আঘাত লাগলেও প্রাণে বেঁচে গেলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে বাঁচার জন্য ওই তরুণ লাশগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসতেই পাকিস্তানি বাহিনী লাশগুলো দ্রুত মাটিচাপা দিয়ে চলে যায়।
তারপর সেই তরুণ মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হামাগুড়ি দিয়ে সুকচা গ্রামের একটি বাড়ির কাছে এসে চিৎকার করেন। তখন বাড়ির লোকেরা বেরিয়ে এসে তাঁকে ঘরে তুলে নেন এবং পরদিন তাঁকে নিয়ে যান পারকুলা গ্রামে।
তখন আরও অনেকের সঙ্গে আমিও ওই তরুণের চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। পালাক্রমে সেবা করি। দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন সেই তরুণ। আমি তত দিনে করিমপুর মুক্তি ফোর্স ক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। সব সংবাদ সেখানে পৌঁছে দিতাম। সেই তরুণ পুরোপুরি সেরে উঠলে তাঁকে করিমপুর মুক্তি ফোর্স ক্যাম্পে পাঠানো হয়। পরে তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
আলমডাঙ্গার দারুস সালামের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মো. ফজলুল হক। তিনি ছিলেন খুব মেধাবী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কারণ, তাঁর প্রতিষ্ঠিত দারুস সালামের ভেতর মুক্তিযোদ্ধারা এসে লুকাতেন। ফজলুল হক দারুস সালাম প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁর কবর সেখানে হয়নি। তাঁর স্মৃতির সাক্ষী হয়ে আছে আলমডাঙ্গার দারুস সালাম।
আলমডাঙ্গা পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষককে পাকিস্তানিরা নির্মমভাবে মারধর করে। কারণ, তাঁর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা খেতে আসতেন। পাকিস্তানিরা প্রাণে মারেনি, কিন্তু তাঁকে আধমরা করে রাখে। স্বাধীনতার পরও তিনি যত দিন বেঁচে ছিলেন, তত দিন তাঁর মুখ দিয়ে রক্ত পড়ত।
মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৫-৬ তারিখে একদিন পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ধরার জন্য তাড়া করে। মুক্তিযোদ্ধারা ভয়ে কুমার নদের মধ্যে সব অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। পাকিস্তানিরা সেই অস্ত্র তোলার জন্য সব ছেলে-বুড়োকে পানিতে নামায়। তখন শীত প্রায় শুরু। সেই শীতের মধ্যে সবাই পানিতে নামতে বাধ্য হয়েছিল।
তীব্র ঠান্ডা ছিল কুমার নদের পানি। সেই পানিতে সবাই নেমে অস্ত্র খুঁজে পেলেও কেউ তোলেননি। কারণ, তাঁরা জানতেন অস্ত্রগুলো পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিলেও তাঁদের প্রাণ হারাতে হবে। তাই সবাই অস্ত্র খোঁজার ভান করে পানির মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকেন। অবশেষে সন্ধ্যা নেমে আসে। তখন পাকিস্তানি বাহিনী চলে যায়।
তারপর সবাই সেই ঠান্ডা পানি থেকে কাঁপতে কাঁপতে উঠে আসেন। তাঁরা পানি থেকে উঠলেও প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিলেন। আর কিছুক্ষণ পানিতে থাকলে হয়তো প্রাণ নিয়ে উঠে আসতে পারতেন না।