স্যার ফজলে হাসান আবেদ যে ভাবনা থেকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় গড়েছিলেন, সেই ভাবনার প্রতিফলন কি বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে?
সত্যি বলতে, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা এমন অনেক কিছুই করছি, যা তাঁর চিন্তা-চেতনা থেকে অনুপ্রাণিত। কিন্তু আমরা পুরোপুরি সফল—এ দাবি করা যাবে না। তাঁর কাজের যে পরিধি ও ব্যাপ্তি, তা পুরোপুরি বুঝতে হলে গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণা হলে আমরা নতুন নতুন ধারণা পাব। যেমন তিনি বাংলাদেশের আনাচকানাচে হাজারো স্কুল করেছেন, যেখানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পড়ছে। এই সাহস করাই তো অনেক বড় ব্যাপার। প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও বিভিন্ন ধরনের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়েরও কি ‘প্রথার বাইরে’ কোনো উদ্যোগ আছে?
নিশ্চয়ই। আমাদের এখানে যেমন শিক্ষার্থীদের একটা রেসিডেনসিয়াল (আবাসিক) সেমিস্টার করতে হয়—সাভারে। পুরো একটা সেমিস্টার শিক্ষার্থীরা সেখানে থাকে। বিভিন্ন সামাজিক, ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে পরিচিত হয়। বিভিন্ন বাস্তবিক সমস্যার সমাধান খোঁজে। যেমন একটা উদাহরণ দিই। রেসিডেনসিয়াল সেমিস্টারে একটা দিন ক্যাম্পাসের সমস্ত কার্যক্রম শিক্ষার্থীরা পরিচালনা করে। বাজার, রান্না থেকে শুরু করে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া—সব। এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের আচরণে একটা পরিবর্তন আসে। আগে হয়তো ওরা ভাবত, যিনি রান্না করেন কিংবা নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন, তাঁর কাজ এমন কিছু নয়। কিন্তু ওই দিনের অভিজ্ঞতার পর শিক্ষার্থীরা বোঝে, সবার কাজই গুরুত্বপূর্ণ। এতে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বেড়ে যায়।
ব্র্যাকের ব্যাপ্তির কথা বলছিলেন। এ ব্যাপ্তি কি কোনোভাবে শিক্ষার্থীদের কাজে আসে? ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেশ কিছু ইনস্টিটিউট আছে, সেন্টার আছে। এগুলো কি ইন্ডাস্ট্রি ও একাডেমিয়ার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে সহায়তা করে?
আমাদের কিছু কিছু ইনস্টিটিউটের কাজ বিশ্বমানের। যেমন আমাদের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস, সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিরশিপ ডেভেলপমেন্ট, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট আছে, সব কটিই বেশ সক্রিয়। ইনস্টিটিউটগুলো শিক্ষার্থীদের উপকারে আসে দুভাবে। প্রথমত তারা মাঠপর্যায়ে কাজ করে বাস্তবিক অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পায়। যেমন রোহিঙ্গা শিবিরের কয়েকটি প্রকল্পে আমাদের ইনস্টিটিউটগুলো কাজ করছে। এসব প্রকল্পে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়। ফলে তাদের থিসিসে একটা বাস্তবিক সমস্যার প্রতিফলন থাকে, সে সেটার সমাধান খোঁজে। এটা একটা উদাহরণ হিসেবে বললাম। এমন আরও অনেক প্রকল্প আছে। শুধু ব্র্যাক নয়, ব্র্যাকের বাইরেও আমরা অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করি। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের প্রকল্পে যে পেশাজীবীরা কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটা যোগাযোগ তৈরি হয়। এটা অনেক বড় পাওয়া। এ যোগাযোগ কিন্তু ক্লাসরুমে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে যখন প্রথম কম্পিউটার এল, শুরুর দিকের সময়টা আপনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এখন যেমন এআই নিয়ে কথা হচ্ছে, অনেকে বলছে এআই মানুষের চাকরি ‘খেয়ে ফেলবে’। সে সময়ও কি এ ধরনের আলোচনা হয়েছিল?
তখন আসলে আলোচনাটা ঠিক এ রকম ছিল না, যত দূর মনে পড়ে; বরং অনেক বেশি কৌতূহল ছিল। সত্তরের দশকের শেষ দিকে আমরা পাঞ্চকার্ডে প্রোগ্রাম লিখতাম, তখন মেমোরি বলে কিছু ছিল না। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা বলছি। শুধু বুয়েটে আর আমার কিছুদিনের কর্মস্থল পরমাণু শক্তি কমিশনে মেইন ফ্রেম কম্পিউটার ছিল। সে সময়েও সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিল। এআই নিয়ে যে দুশ্চিন্তা, এটা আসতেই পারে। কিন্তু নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কিন্তু এর রক্ষণাবেক্ষণ, উন্নয়ন—এসবও যুক্ত। এসবের জন্য কিন্তু অনেক দক্ষ লোক লাগবে। আমাদের আসলে ভয় না পেয়ে নতুন প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাতে হবে, তবে সতর্কতার সঙ্গে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো বটেই, বাইরের শিক্ষার্থীরাও বেশ রোমাঞ্চিত। নতুন ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের কীভাবে অনুপ্রাণিত করবে?
এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্নের একটা বাস্তবায়ন। আমরা মহাখালীর বিভিন্ন ভবনে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ছিলাম, এখন একই ছাদের নিচে আসব। শিক্ষার্থীরা অনেক খোলামেলা, সুন্দর পরিবেশ পাবে। স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক যোগাযোগটা অনেক বেড়ে যাবে। শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই বড় ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। নতুন ক্যাম্পাসে আসতে শিক্ষার্থীরা মুখিয়ে আছে।
২০২৩ শেষ হয়ে এল। ২০২৪ সালের এই সময়ে যদি আবার আপনার কাছে আসি, তখন কী খবর দিতে চান?
স্বপ্নের কথা বলতে হবে। স্বপ্ন সব সময় ধরা দেয় না। সে জন্য আমরাও বাস্তবসম্মত স্বপ্নই দেখতে চাই। প্রথমত, শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য আমরা একটা লার্নিং অ্যান্ড টিচিং ইনোভেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি। শুধু ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারা দেশের জন্য এ সেন্টার কাজ করবে। লক্ষ্য হবে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো। আশা করছি, আগামী বছর এই সময়ের মধ্যে সেন্টারটা দাঁড়িয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, গবেষণায় আরও অগ্রগতি। স্কোপাস ইনডেক্সে কিউ-১ ক্যাটাগরিতে এ বছর আমাদের শিক্ষকদের ৭৮টি গবেষণা স্থান পেয়েছে। আগামী বছর এই সময়ে যেন বলতে পারি, সংখ্যাটা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।