ঢাকার ৩৮ বছরের পুরোনো এই বিয়েবাড়ি কত বিয়ের সাক্ষী
বাড়িটা দোতলা। আকাশি-বেগুনি রঙের নকশা করা সীমানাপ্রাচীর। মরিচবাতির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই আম-কাঁঠাল গাছে ঘেরা বাড়িটার রংও আকাশি। সিঁড়ির পরে লালগালিচা পাতা পথ ধরে এগিয়ে গেলেই হলরুম। ৫৫ পুরান পল্টন ভিআইপি রোডের এই বাড়িটাই আনন্দ ভবন কমিউনিটি সেন্টার। ঢাকায় বহু বিয়ের সাক্ষী।
৩৮ বছর আগে যখন বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই ছিল বর বা কনের বাড়ির সামনে অথবা ছাদে সামিয়ানা টানিয়ে ভোজের আয়োজন, তখন গড়ে উঠেছিল এই কমিউনিটি সেন্টার। ঢাকায় তখন কমিউনিটি সেন্টার হাতে গোনা। দুই দশক আগেও মাসের বেশির ভাগ সময় এখানে বিয়ের অনুষ্ঠান লেগে থাকত। এককালের রমরমা সেই আনন্দ ভবনে আজ ভাটার টান। নতুন কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বুকিং দিতে যেখানে এক–দুই মাস হাতে রাখতে হয়, রেস্তোরাঁগুলোও যেখানে দুই শিফটে ভাড়া খাটছে, সেখানে বিয়ের এই ভরা মৌসুমেও প্রতিদিন তো দূরের কথা, মাসে পাঁচ থেকে সাতটির বেশি বিয়ের আয়োজন নেই।
আনন্দ ভবনের এই দশা কি করে হলো, জানতে চেয়েছিলাম কমিউনিটি সেন্টারটির ব্যবস্থাপক শামসুর রহিম কাছে। তিনি জানালেন, করোনার পর থেকে অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমে এসেছে। আর এখন তো ঢাকায় চাকচিক্যে ভরা শত শত কমিউনিটি সেন্টার। মানুষের হাতে টাকাও অনেক। তার সঙ্গে আছে সাম্প্রতিক সময়ের অস্থিতিশীল পরিবেশ। এই বাড়ির আশপাশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অফিস, রাজনৈতিক দলের কার্যালয় থাকায় এখানে বিয়ের অনুষ্ঠান করাকে অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। আর তাই দিন দিন কমিউনিটি সেন্টারটির চাহিদা কমছে।
তবে একটু একটু করে নিজেদের আপডেট করার চেষ্টা করছে আনন্দ ভবন। এই যেমন একসময় বুকিং করার জন্য সরাসরি যেতে হতো, এরপর এল মুঠোফোন, এখন ফেসবুকেও তাদের পেজ আছে। সেখান থেকেও মিলছেও বুকিং–সংক্রান্ত সেবা। তাই শামসুর রহিমের আশা, দ্রুতই আবার পুরোনো দিনের মতো কর্মব্যস্ত হবে আনন্দ ভবন। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য এই কমিউনিটি সেন্টার সুবিধাজনক। দিনে ও রাতে দুটি পর্বে ভাড়া নেওয়ার সুযোগ আছে। সাধারণত বিকেল পাঁচটার মধ্যেই শেষ করতে হয় দিনের আয়োজন। আর রাতের আয়োজন সন্ধ্যা থেকে শুরু করে চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। হিন্দু ধর্মের বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময় ভোর পর্যন্ত হয়ে যায়। আনন্দ ভবনে সেই সুবিধাও আছে। ভবনের দুটি তলাজুড়ে একসঙ্গে ৩০০ জন অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থা আছে।
অনেক বিয়ের ভেন্যুতেই আজকাল মূল সমস্যা ভাড়া। অন্য অনেক কমিউনিটি সেন্টারের ভাড়া যেখানে লাখ টাকার ওপরে, আনন্দ ভবনে সেখানে ৫০ হাজার টাকা। আরেকটা সমস্যা থেকেও মুক্ত আনন্দ ভবন। অন্য কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিলে সঙ্গে সাজসজ্জা এবং বাবুর্চিসেবাও ভেন্যু–মালিকদের নির্ধারিত লোকের কাছ থেকে নিতে হয়। আনন্দ ভবনে এই বাধ্যবাধকতা নেই। গ্রাহক তাঁর ইচ্ছেমতো মেন্যু ও ডেকোরেশন করতে পারেন।
আনন্দ ভবনের পাশেই এক তরুণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ। তিনি বলেন, এখনকার বিয়েতে নানা রকম থিম থাকে, অনেকে নিজেদের মতো সাজানোর জন্য পুরোনো দোতলা বাড়িও খোঁজেন। সেদিক থেকে আনন্দ ভবন ভালো ভেন্যু, ভাড়াও কম। তবে এই রাস্তা অনেক সময় রাজনৈতিক কারণে অস্থির থাকে, তাই বিয়ের আয়োজনের জন্য ভেন্যুটার চাহিদা কম। আসলে বিয়ের মতো বিশেষ দিনে কেউ ঝুঁকি নিতে চায় না।
শুধু ঝুঁকি নয়, এই এলাকা একসময় যেমন ঢাকার কেন্দ্র ছিল, এখন আর সেটি নেই। বছর বছর চারদিকে প্রসারিত হচ্ছে ঢাকা, গড়ে উঠছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধার আবাসিক এলাকা। দিন দিন তাই ফিকে হয়ে আসছে বিয়েবাড়ির রোশনাই ছড়ানো আনন্দ ভবন।