বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্রের ভান্ডার থেকে পাঁচটি গল্প

ফেসবুক প্ল্যাটফর্মটির নাম ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’। ফরিদপুরের গিরিধর দের একক উদ্যোগে ২০১৬ সালে চালু হওয়া এই প্ল্যাটফর্মে এখন ১০ লাখের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীর আনাগোনা। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের একটি ডিজিটাল সংগ্রহশালা গড়ে তোলাই ছিল গিরিধরের লক্ষ্য। তবে এই কাজগুলো করার পাশাপাশি এখন মানুষে মানুষে সেতুবন্ধও গড়ে দিচ্ছে এই প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি যেমন ৪৭ বছর আগের একটি ছবির মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বান্ধবীর পুনর্মিলন ঘটিয়েছে ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’। উদ্যোগটির ভান্ডারে এমন আরও অনেক গল্পই জমা আছে। সেখান থেকে পাঁচটি গল্প জেনেছেন সজীব মিয়া

১. দেশভাগের স্মৃতি

বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র থেকে পুরোনো পেপার কাটিংয়ের ছবিটি পোস্ট করা হয়েছিল ২০২০ সালে

১৯৪৬ সাল। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে কৃতী ১০ শিক্ষার্থী ও তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম। প্রথম নামটি পিরোজপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র থেকে পুরোনো পেপার কাটিংয়ের ছবিটি পোস্ট করা হয়েছিল ২০২০ সালে। পোস্টে অনেকে নানা মন্তব্য করেছেন। তাঁদেরই একজন মধুমিতা গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে, থাকেন কলকাতায়।

কৃতী শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়া সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের পদক
ছবি: সংগৃহীত

পরে আপ্লুত মধুমিতা নিজেও একটি পোস্ট লেখেন বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র গ্রুপে। সঙ্গে জুড়ে দেন সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্মৃতিসুধা’ নামে একটি লেখা। যে লেখায় দুজন মানুষের গল্প বলেছেন সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়—একজন তাঁর শিক্ষক, আরেকজন বন্ধু। লেখাটির পরতে পরতে মিশে আছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক, দেশভাগ, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের গল্প।

সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়
ছবি: সংগৃহীত

দেশভাগের পর কলকাতায় থিতু হন সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়। তবে এপারের দুজন মানুষকে তিনি ভোলেননি। নানা সময় খোঁজ করেছেন। তবে জীবদ্দশায় তাঁদের আর দেখা হয়নি। মধুমিতাও চেষ্টা করেছেন, চেয়েছেন অন্তত একবারের জন্য হলেও তাঁর পিতার ইচ্ছা পূরণ হোক। কিন্তু কোনোভাবেই তা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্রের পোস্টের মাধ্যমে পরে সুধীরকুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের শিক্ষক সামসুদ্দিন ও বন্ধু মানিকের খোঁজ মিলেছিল। কিন্তু তত দিনে এই দুজনও প্রয়াত। আছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।

২. তিয়াত্তরের কম্বল

১৯৭৩ সাল। জিনাত বেগম তখন ইডেন মহিলা কলেজে স্নাতক পড়েন। থাকেন আজিমপুর কলোনিতে। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন দেশ থেকে সহযোগিতা আসছে। এমনই সহায়তা হিসেবে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার পেয়েছিল কম্বল। তারই একটি পেয়েছিলেন জিনাত বেগম।

কম্বল হাতে জিনাত বেগম
ছবি: সংগৃহীত

জিনাত বেগমের বয়স এখন ৭১ বছর। কম্বলটি আজও আগলে রেখেছেন তিনি। ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ গ্রুপে কম্বলের ছবি তুলে পোস্ট করেন জিনাত বেগমের ছেলে মোকারম হোসেন। ক্যাপশনে লেখেন, ‘১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে সাত কোটি মানুষের মাঝে যে কম্বল বিতরণ করেছিলেন, তার একটি আমার মায়ের কাছে আজও স্মৃতি হিসেবে রক্ষিত আছে। ছাই রঙের জমিনে লাল স্ট্রাইপের কম্বলটি স্টোররুমের পুরোনো আলমারি থেকে বের করলাম।’

৩. সিন্দুকনামা

পুরোনো সিন্দুকটি মেঝেতে রাখা। তালাবদ্ধ। দেখে মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে মরচে পড়তে শুরু করেছে।

পারিবারিক সিন্দুকের ছবিটি পোস্ট করেছেন মাসুদ খান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফরদাবাদ দক্ষিণ পাড়ায় তাঁদের বাড়ি। সেখানেই আছে সিন্দুকটি। কিন্তু সিন্দুকটিতে কী আছে, তা মাসুদ খানেরা কেউ জানেন না। জানবেন কী করে, সিন্দুকটি যে খোলাই যায় না।

পারিবারিক সিন্দুকের ছবিটি পোস্ট করেছেন মাসুদ খান
ছবি: সংগৃহীত

ছবির ক্যাপশনে মাসুদ খান জানিয়েছেন, গত শতকের ত্রিশের দশকে তাঁর দাদা কলকাতা থেকে সিন্দুকটি কিনেছিলেন। অবিভক্ত ভারতে তাঁর বাবা সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। সময়ের নিয়মে মাসুদ খানের দাদা ষাটের দশকে মারা যান। তাঁর বাবাও চলে যান ২০০৩ সালে। তাঁদের মৃত্যুর পর সিন্দুকটি আর খোলা হয়নি।

৪. হারানো বান্ধবীদের খোঁজে

১৯৯৫ সাল থেকে ছবিটি আগলে রেখেছেন বন্দনা কবীর। তাঁর কাছ থেকে ছবিটি নিয়ে ‘বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবি সমগ্র’ গ্রুপে পোস্ট করেন রুমা মোদক। রঙিন এই ছবিতে বন্দনাসহ আছেন তাঁর কলেজপড়ুয়া সাত বান্ধবী। যোগাযোগহীনতায় প্রাণের এই বান্ধবীদের হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তার পর থেকে হারানো বান্ধবীদের খুঁজেই চলেছেন বন্দনা।

কলেজপড়ুয়া সাত বান্ধবীর ছবিটি পোস্ট করার পর দুই বান্ধবীর খোঁজ মিলেছে
ছবি: সংগৃহীত

বন্দনা কবীরের বন্ধু–সন্ধান অভিযান এবার বোধ হয় শেষ হবে। কারণ, ছবিটি পোস্ট করার পরপরই দুজনের খোঁজ পেয়েছেন তিনি। উচ্ছ্বসিত বন্দনা কবীর মন্তব্য করেছেন রুমা মোদকের পোস্টে, ‘২০০৮ থেকে ফেসবুক ব্যবহার করি। তখন থেকে কতবার যে এই ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছি। কত বন্ধু কত কত ফেসবুকের পাবলিক গ্রুপে যে ছবিটি পোস্ট করে বন্ধুদের খুঁজেছি! তারও আগে কত কত পন্থায়, কতবার যে ওদের খুঁজেছি! কোনো ফল হয়নি। (দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র গ্রুপে পোস্ট করার পর) একজনকে খুঁজে পেলাম এক ঘণ্টার মধ্যেই! অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।’

এতক্ষণে হয়তো বাকি বন্ধুদেরও খুঁজে পেয়েছেন বন্দনা কবীর।

৫. ‘কবিগুরু আমাদের বাড়ি এসেছিলেন’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুপাশে চারজন চেয়ারে বসা, তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছয়জন, রবীন্দ্রনাথের পা ঘেঁষে মেঝেতে বসা আরও দুজন। পারিবারিক সংগ্রহ থেকে ছবিটি বাংলাদেশের দুষ্প্রাপ্য ছবিসমগ্র গ্রুপে পোস্ট করেছেন ইন্দ্রানী দে। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘কবিগুরু যখন আমাদের বাড়ি এসেছিলেন, তখন তোলা। ঢাকার বলধার বাড়ি ও বাগানে (বলধা গার্ডেন)। কবিগুরুর ডান পায়ের সামনে আমার ঠাকুরমা স্বর্গীয়া সুনীতিবালা রায়চৌধুরীর একমাত্র ছোট ভাই নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী ও কবির বাঁ পাশে ঠাকুরমার বাবা এবং বলধা এস্টেটের জমিদার ও বলধা গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী বসে আছেন।’

ঢাকায় গুণীজনদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৬
ছবি: সংগৃহীত

ইন্দ্রানী দের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেল বর্তমানে পরিবারের সঙ্গে তিনি ঢাকায় থাকেন। সুস্থ আছেন। তাঁর বাবা কাশিমপুরের শেষ জমিদার প্রয়াত অনামীপ্রসাদ রায়চৌধুরী।

রবীন্দ্রনাথের ছবিটি সম্পর্কে বললেন, বলধা গার্ডেনের সিবিলি অংশে ১৯২৬ সালে তোলা হয়েছিল এটি। সে সময়ের বিখ্যাত ব্যক্তিরা ছবিতে কবির পাশে আছেন, যাঁদের মধ্যে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারও আছেন।