আজিজুল হক কলেজ কেন ‘আপন-আপন লাগে’

পরিবেশের কারণেই এই কলেজ আলাদা, বলছেন শিক্ষার্থীরা
ছবি: সোয়েল রানা

আজিজুল হক কলেজে কেন পড়ব? প্রশ্নটা করেছিলাম রেজওয়ানুল ইসলামকে। ইসলামিক ইতিহাস বিভাগের এই ছাত্রকে প্রশ্নটি আরেকটু বুঝিয়ে বললাম, ‘ধরুন, বগুড়া অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজ শেষ করে কেন আপনার কলেজে ভর্তি হবে?’

উত্তরটা মনে হয় তৈরিই ছিল। রেজওয়ানুল ঝটপট বললেন, ‘প্রথমত, এই কলেজের পরিবেশ। এত বিশাল ক্যাম্পাস, এত সাজানো–গোছানো জায়গা আপনি আর কোথায় পাবেন? রাজনৈতিক হট্টগোল তেমন নেই। তা ছাড়া আমরা খুব ভালো কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছি।’

আজিজুল হক কলেজের আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করেও একই রকম উত্তর মিলল। তবে ভিন্ন একটা কারণও রেজওয়ানুলরা এখন বলতেই পারেন। তা হলো, সম্প্রতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৮৮১টি স্নাতক পাঠদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে র‍্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় হয়েছে বগুড়ার এই কলেজ। শুধু পরিবেশ নয়, পড়ালেখার মানের কারণেও উত্তরবঙ্গের বহু পুরোনো এই প্রতিষ্ঠানটির বিশেষ সুনাম আছে।

আরও পড়ুন

১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আজিজুল হকের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিদ্যাপীঠ। গত ৮৬ বছরে কলেজটি নানা রকম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। তবে এইচএসসি বা স্নাতকের ফলাফল বিবেচনায় আজিজুল হক কলেজের সুনাম সব সময়ই ছিল। ২০২৩ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন ১ হাজার ৩৩৪ জন, পাস করেছেন ১ হাজার ৩৩৩ জন। আর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ হাজার ৮ জন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আজিজুল হকের নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিদ্যাপীঠ
ছবি: সোয়েল রানা

উত্তরের আলো হিসেবে খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানে এখন উচ্চমাধ্যমিক ছাড়াও ২৩টি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার।

অ্যালামনাইরা কী বলছেন

আজিজুল হক কলেজের অর্থনীতি বিভাগ ইদানীং বেশ সরগরম। ২৪ ফেব্রুয়ারি বিভাগের পুনর্মিলনী। পুরোনো শিক্ষার্থীরা একেকজন একেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে আবার এক হতে শুরু করেছেন তাঁরা। মেসেঞ্জারে, মেসেজে বা হোয়াটসঅ্যাপেও চলছে বার্তা আদান-প্রদান: ‘আমি আসছি! তুই আসবি না?’

আরও পড়ুন

আয়োজনের এই মহাযজ্ঞে যুক্ত আছেন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র মাসুদ আল আমিনও। তিনি বর্তমানে জেনারেল ইলেকট্রিক ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান অঞ্চলের ‘কান্ট্রি কাস্টমস লিডার’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৭ সালে কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেছিলেন। পরে এমবিএ করেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মাসুদ বলেন, ‘বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাকরির ক্ষেত্রে ইন্টারভিউ বোর্ড পর্যন্ত যাওয়াই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটা বড় চ্যালেঞ্জ। বেশির ভাগ কোম্পানিই নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাধান্য দেয়। এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা আমাকেও করতে হয়েছে। তবে এখন কিন্তু সময় বদলাচ্ছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা পরে দেখি। আগে দেখি দক্ষতা আছে কি না।’

এই কলেজের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থীই এখন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো অবস্থানে আছেন
ছবি: সোয়েল রানা

এখনকার সময়ে চাকরির জন্য দক্ষতাই সবচেয়ে জরুরি, সে কথাই অনুজদের মনে করিয়ে দিতে চান মাসুদ আল আমিন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আজিজুল হক কলেজ থেকে তিন-চার হাজার স্নাতক বের হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন হয়তো দারুণ ভালো কোনো অবস্থানে পৌঁছাতে পারছেন। তাঁরা কেন আলাদা? কেন একস্ট্রা অর্ডিনারি? তাঁরা কীভাবে তৈরি হয়েছেন? সেটাই বর্তমান শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা উচিত। হোক সেটা সেমিনার, প্রশিক্ষণ কিংবা কর্মশালার মাধ্যমে।’ মাসুদ জানালেন, পুনর্মিলনীর কাজে গত এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই চার-পাঁচবার বগুড়া গিয়েছেন তিনি। শিক্ষক-অ্যালামনাইদের সঙ্গে বসেছেন, আলোচনা করেছেন। নতুন-পুরোনোর একটা সেতুবন্ধ তৈরির মধ্য দিয়েই প্রিয় কলেজকে এগিয়ে নিতে চান তাঁরা।

আরও পড়ুন

৪৩তম বিসিএসে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন আব্দুল আলিম। এখন এনসিসি ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার (জেনারেল) হিসেবে কাজ করছেন। শিগগিরই কৃষি ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ দেবেন। আজিজুল হক কলেজ থেকে বিবিএ-এমবিএ করা এই শিক্ষার্থী মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কীভাবে নিজেকে তৈরি করব, তা আসলে অনেকাংশে নিজের ওপরই নির্ভর করে। আলিম বলছিলেন, ‘আমি আসলে সব সময়ই নেটওয়ার্কিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। আমাদের কলেজের একটা ভালো দিক হলো, ক্লাস নিয়মিত হয়। খুব ভালো শিক্ষক পেয়েছি। ক্লাসের বাইরেও শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছি। তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর থেকেই সিনিয়র ভাইয়া-আপুদের একটা গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি, চাকরির প্রস্তুতি নিয়েছি। এই গ্রুপ স্টাডিটা বেশ কাজে এসেছে।’ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন খাতে আজিজুল হক কলেজের অনেক অ্যালামনাই বেশ ভালো অবস্থানে আছেন, সে কথা বেশ গর্ব নিয়েই মনে করিয়ে দিলেন আব্দুল আলিম। তিনি বলছিলেন, ‘ইউএনও, পুলিশ সুপার ও ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা হিসেবেও আমাদের অনেক ভাইবোন কাজ করছেন। অ্যালামনাইদের নেটওয়ার্কটা যদি আরও মজবুত হয়, তাহলে নিশ্চয় জুনিয়ররাও উপকার পাবে।’

গৌরবের আট দশক

মাসুদ আল আমিন, আব্দুল আলিমের মতো প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাই বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রেরণা। তবে অনেক শিক্ষার্থীই হয়তো জানেন না, একসময় এই কলেজেরই শিক্ষার্থী বা শিক্ষক ছিলেন আরও কত গুণীজন।

সরকারি আজিজুল হক কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে এ কলেজের বেশ কয়েকজন ছাত্র শহীদ হন। শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যিক শাহেদ আলী, কবি আতাউর রহমান। এ ছাড়া কণ্ঠশিল্পী শওকত হায়াত খান, কবি মহাদেব সাহা, ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ড. আনোয়ার হোসেন, জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ড. এনামুল হক, শিক্ষক মমতাজুর রহমান তরফদারসহ অনেক গণ্যমান্য এই কলেজে পড়েছেন।

৮৬ বছরের গৌরব ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজিজুল হক কলেজের পুরোনো ভবন। এখানে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠদান কার্যক্রম চলে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আবাসনের জন্য আছে ফখরুদ্দিন আহমদ হল।

অন্যদিকে কলেজের নতুন ক্যাম্পাসে দৃষ্টিনন্দন প্রশাসনিক ভবন, কলা ভবন, চারতলা বিজ্ঞান ভবন, পাঁচতলা ব্যবসায় শিক্ষা ভবন, দোতলা গ্রন্থাগার ছাড়াও চালুর অপেক্ষায় আছে বহুতলবিশিষ্ট অত্যাধুনিক একাডেমিক ভবন। ১০০টি শ্রেণিকক্ষ ও ১৮টি গবেষণাগারে পাঠদান যে পুরোদমেই চলে, বোঝা গেল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে।

রসায়ন বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়েন সাদিয়া শারমিন। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের ল্যাব ক্লাসগুলোতে অনেক কড়াকড়ি। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্লাস হয়। শিক্ষকেরা খুবই ভালো। আমাদের খুব সাহায্য করেন, অনুপ্রেরণা দেন। আমার ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হব। মেডিকেলে চান্স না পেয়ে একটু ভেঙে পড়েছিলাম। তবে এখন আর আফসোস করি না। একসময় আজিজুল হক কলেজেই উচ্চমাধ্যমিকে পড়েছি। তাই সব মিলিয়ে ক্যাম্পাসটা কেমন “আপন-আপন”লাগে!’

মানবতার সেবক হও

খোন্দকার কামাল হাসান, অধ্যক্ষ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ

‘বগুড়ায় কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। এ কারণে উত্তরবঙ্গের মেধাবী বা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় ভরসা এখন সরকারি আজিজুল হক কলেজ। উচ্চশিক্ষায় যুগোপযোগী আরও ১৯টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালুর জন্য আমরা আবেদন করেছি। এই উদ্যোগ বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। আশা করছি, খুব শিগগির অনুমোদন পাওয়া যাবে। স্নাতক পর্যায়ে যেমন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর মধ্যে পারফরম্যান্স র‍্যাঙ্কিংয়ে আমরা তৃতীয় হয়েছি, তেমনি জিপিএ-৫–এর সংখ্যাগত সূচকেও টানা কয়েক বছর ধরে আমাদের কলেজ দেশসেরার সাফল্য ধরে রেখেছে। “মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে মানবতার সেবক হও” প্রতিপাদ্যে সরকারি আজিজুল হক কলেজ উত্তরের জনপদে আলো ছড়ানোর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।’