যে শহরে সবাই থাকে একই ছাদের নিচে
পৃথিবীর বুকে সত্যিই এমন এক শহর আছে, যেখানে পুরো শহরের প্রায় সব বাসিন্দা একটি ভবনে বাস করেন! শহরটির নাম হুইটিয়ার। আর সেখানকার বিখ্যাত সেই ১৪ তলা ভবনটির নাম বেগিচ টাওয়ার্স। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই শহর বাইরের জগৎ থেকে এক অর্থে বিচ্ছিন্ন। এখানে পুলিশ স্টেশন, ডাকঘর, হাসপাতাল, দোকানপাট, এমনকি গির্জা পর্যন্ত এক ছাদের নিচে। চলুন, পৃথিবীর অন্যতম অদ্ভুত এই শহর থেকে একটু ঘুরে আসি।
একটুখানি কল্পনা দিয়ে শুরু করা যাক। সকালে ঘুম থেকে উঠলেন। ফ্রেশ হয়ে চা-কফি খাবেন। কিন্তু ঘরে নেই চিনি। স্লিপারটা পায়ে দিয়ে লিফটে চড়ে নামলেন নিচে। মুদিদোকান থেকে চিনি কিনলেন। ফেরার পথে লিফটেই দেখা হলো শহরের মেয়রের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গেও একটু হাই-হ্যালো করলেন।
এরপর চা–পর্ব শেষে সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যেতে হবে। সমস্যা নেই, ভবনের নিচ দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ আছে, সেটা পার হলেই স্কুল। বাইরে তুষারঝড় বা হাড়কাঁপানো শীত, কিন্তু আপনার গায়ে একফোঁটা হাওয়াও লাগছে না।
কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বা গল্পের প্লট বলছি না। আলাস্কার হুইটিয়ার শহরের বিখ্যাত ১৪ তলা ভবন বেগিচ টাওয়ার্সে ঠিক এমনটাই হয়।
সুড়ঙ্গ পেরিয়ে
হুইটিয়ার শহরে ঢোকা মোটেও সহজ কাজ নয়। এখানে পৌঁছাতে হলে আপনাকে পেরোতে হবে পাহাড়ের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া প্রায় ৪ কিলোমিটার লম্বা এক অন্ধকার সুড়ঙ্গ। নাম অ্যান্টন অ্যান্ডারসন মেমোরিয়াল টানেল। এটি উত্তর আমেরিকার দীর্ঘতম হাইওয়ে টানেল।
মজার ব্যাপার হলো, এই টানেল এতটাই সরু যে এর ভেতর দিয়ে একসঙ্গে দুটি গাড়ি যাতায়াত করতে পারে না। শুধু তা–ই নয়, এই রাস্তার ওপর দিয়েই আবার রেললাইন চলে গেছে! অর্থাৎ যখন ট্রেন চলে, তখন গাড়ি বন্ধ। আবার গাড়ি যখন চলে, তখন একবার গাড়ি শহরে ঢোকে, আরেকবার শহর থেকে বের হয়।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, রাত ১০টার পর এই টানেলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আপনি যদি রাত ১০টার মধ্যে শহরে ঢুকতে না পারেন, তবে আপনাকে সারা রাত গাড়িতে বা পাহাড়ের পাদদেশে অপেক্ষা করতে হবে।
বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের এটাই একমাত্র স্থলপথ। অবশ্য আবহাওয়া ভালো থাকলে নৌকা বা ফেরিতে করেও যাওয়া যায়। কিন্তু আলাস্কার যা আবহাওয়া, তাতে ওটা ভরসা করা কঠিন।
খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা এক শহর
টানেল পার হয়ে শহরে ঢুকলেই চোখে পড়বে বিশাল সব পাহাড়, হিমবাহ আর নীল সমুদ্র। আর এই প্রকৃতির মাঝখানে নিঃসঙ্গ প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ১৪ তলা বেগিচ টাওয়ার্স। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, পুরোনো কোনো জরাজীর্ণ হোটেল। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই আপনি চমকে যাবেন! কী নেই সেখানে!
শহরের মোট জনসংখ্যা ঋতুভেদে ২০০ থেকে ৩০০-র মধ্যে ওঠানামা করে। আর এই জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই বাস করে এই একটি ভবনে। স্থানীয় লোকজন একে আদর করে ডাকে বি-টাওয়ার।
এখানে কী কী আছে
এই ভবন আদতে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মিনি-সিটি। এর ভেতরে অনেক কিছু আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও যেসব সমাজে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি, সেসব এখানে আলোচনা করছি। তবে এই তালিকার বাইরেও আরও অনেক কিছু আছে, যা এই ভবনের মধ্যেই জায়গা পেয়েছে।
পুলিশ স্টেশন: নিচতলায় শহরের একমাত্র পুলিশ স্টেশন। কোনো ক্রাইম হলে পুলিশকে গাড়ি বের করতে হয় না, শুধু লিফটে করে ওপরে গেলেই হলো।
ডাকঘর: আপনার চিঠি বা পার্সেল নিতে বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। ভবনের ভেতরেই আছে ডাকঘর।
দোকানপাট: কোতস স্টোর নামে এখানে একটি বড় মুদিদোকান আছে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে দৈনন্দিন সব জিনিস পাওয়া যায় সেই দোকানে।
লন্ড্রি ও হাসপাতাল: ছোটখাটো অসুখ হলে ভবনের ভেতরেই আছে প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র। কাপড় ধোয়ার জন্য লন্ড্রিও আছে।
গির্জা: প্রার্থনার জন্য বেজমেন্টে আছে গির্জা।
হোটেল: পর্যটকদের থাকার জন্য ওপরের তলাগুলোয় আছে জুনস হুইটিয়ার কন্ডো স্যুটস।
স্কুল কানেকশন: এই ভবনের ঠিক পেছনেই শহরের স্কুল। শিশুরা যাতে শীতে কষ্ট না পায়, সে জন্য ভবন থেকে স্কুল পর্যন্ত মাটির নিচ দিয়ে একটি টানেল বা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। শিশুরা টি-শার্ট পরেই স্কুলে চলে যেতে পারে।
কেন তৈরি হলো এমন অদ্ভুত শহর
হুইটিয়ারের এই অদ্ভুত কাঠামোর পেছনে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও কোল্ড ওয়ারের ইতিহাস। ১৯৪০-এর দশকে জায়গাটি জাপান ও রাশিয়ার খুব কাছে হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি গোপন সেনা ঘাঁটি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়। নাম দেওয়া হয় ক্যাম্প সুলিভান।
মূলত সৈন্যদের থাকার জন্য ১৯৫৭ সালে দুটি বিশাল ভবন তৈরি করা হয়। একটির নাম ছিল বাকনার বিল্ডিং, অন্যটি হজ বিল্ডিং। এই হজ বিল্ডিংয়ের বর্তমান নাম বেগিচ টাওয়ার্স।
বাকনার বিল্ডিংটি একসময় ছিল আলাস্কার সবচেয়ে বড় ভবন, কিন্তু ১৯৬৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এখন ওটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে।
তবে হজ বিল্ডিং বা বেগিচ টাওয়ার্স টিকে যায়। মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর সাধারণ মানুষ এই মজবুত ভবনটিকে নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়ে নেয়। সেই থেকে এটি হয়ে ওঠে এক ছাদের শহর।
কেন সবাই এক ভবনে থাকে
প্রশ্ন জাগতে পারে, এত জায়গা থাকতে সবাই কেন এক ভবনে গাদাগাদি করে থাকে? এর প্রধান কারণ আবহাওয়া। হুইটিয়ারের আবহাওয়া ভীষণ ঠান্ডা। এখানে বছরে গড়ে ২৫০ ইঞ্চি তুষারপাত হয়। মাঝেমধ্যে তা ৪০০ ইঞ্চিও ছাড়িয়ে যায়। আবার শীতকালে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত থাকে। এই বাতাসে বাইরে হাঁটলে আপনি উড়ে যেতে পারেন!
এমন ভয়াবহ আবহাওয়ায় ছোট ছোট আলাদা বাড়ি বানিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব এবং অনিরাপদ। বরফ পরিষ্কার করা, ঘর গরম রাখার ঝামেলার চেয়ে সবাই মিলে এক ভবনে থাকা অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং আরামদায়ক। এখানকার দেয়ালগুলো এত পুরু যে বাইরের তুষারঝড় ভেতরে টেরই পাওয়া যায় না।
বাসিন্দাদের জীবন কেমন
এখানে বসবাস নিঃসন্দেহে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। সবাই সবাইকে চেনেন। এখানে কোনো গোপনীয়তা নেই। কারণ, এখানে আপনি কারও সঙ্গে ঝামেলা পাকিয়ে পালিয়ে থাকতে পারবেন না। যাঁর সঙ্গে সকালে ঝগড়া হয়েছে, বিকেলে লিফটে তাঁর সঙ্গেই দেখা হবে। এমনকি আপনার সন্তানের স্কুলের শিক্ষক হয়তো আপনার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন।
তবে এর একটা ভালো দিকও আছে। এখানকার সামাজিক বন্ধন খুবই দৃঢ়। কেউ অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে পুরো ভবনের মানুষ এক হয়ে যায়। শিশুরা করিডোরে খেলাধুলা করে, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। এক প্রতিবেশী অন্য প্রতিবেশীর জন্য রান্না করে নিয়ে আসেন। যেন বিশাল এক যৌথ পরিবার।
অনেকে মজা করে বলেন, এখানে অনেকে স্লিপার বা পায়জামা পরেই কাজে যায়। কারণ, পুলিশ কর্তারাও জানেন, আপনি আদতে কাজে যাচ্ছেন না, হয়তো নিচতলায় কফি খেতে নেমেছেন।
উপার্জন করে কীভাবে
হয়তো ভাবছেন, সবাই যদি সারাদিন এক ভবনের ভেতরেই থাকে, তবে তাঁরা আয়রোজকার করেন কীভাবে? তাঁরা কি শুধু বসে বসে আড্ডা দেন? একদমই না! হুইটিয়ারের বাসিন্দারা বেশ পরিশ্রমী এবং তাঁদের আয়ের পথগুলোও বেশ রোমাঞ্চকর।
তাঁদের আয়ের প্রধান উৎস সমুদ্র ও বন্দর। হুইটিয়ার আলাস্কার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গভীর সমুদ্রবন্দর। সারা বছর এই বন্দর বরফমুক্ত থাকে। ফলে প্রচুর মালবাহী জাহাজ এবং কার্গো এখানে আসে। আলাস্কান রেলওয়ের সঙ্গে এই বন্দরের সরাসরি সংযোগ থাকায় অনেকেই পোর্ট, রেলওয়ে এবং ফেরি ঘাটের সরকারি চাকরিতে যুক্ত।
দ্বিতীয় বড় খাত হলো বাণিজ্যিকভাবে মৎস্য আহরণ। এখানকার অনেকেই পেশাদার জেলে। তাঁরা বড় বড় ট্রলার নিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে মাছ ধরতে যান এবং কাজ শেষে আবার এই টাওয়ারেই ফিরে আসেন।
তৃতীয়ত, পর্যটন। গরমকালে যখন আবহাওয়া কিছুটা ভালো থাকে, তখন হাজার হাজার পর্যটক ক্রুজ শিপে করে এখানে আসেন। তখন শহরের বাসিন্দারা ট্যুর গাইড, বোট ক্যাপ্টেন, কায়াকিং ইনস্ট্রাক্টর কিংবা স্থানীয় রেস্তোরাঁ ও গিফট শপের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। পর্যটকদের হিমবাহ দেখানোই তখন তাঁদের প্রধান ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়।
এর বাইরেও শহরটা চালানোর জন্য অনেককে কাজ করতে হয়। বেগিচ টাওয়ার্সের রক্ষণাবেক্ষণ, টানেল কন্ট্রোল, রাস্তা থেকে বরফ পরিষ্কার করা, স্কুল শিক্ষকতা, পুলিশ এবং প্রশাসনিক কাজেও অনেকে যুক্ত আছেন। অর্থাৎ তাঁরা এক ছাদের নিচে থাকলেও রুটিরুজির জন্য ঠিকই প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে হয়।
পর্যটকদের জন্য আকর্ষণ
যদিও হুইটিয়ারের জীবনযাত্রা আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হয়, কিন্তু গরমকালে এটি পর্যটকদের জন্য স্বর্গের মতো। প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডের নীল পানি, বিশাল সব হিমবাহ এবং বন্য প্রাণী দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক ক্রুজ শিপে করে এখানে আসেন।
পর্যটকেরাও অবাক হয়ে দেখেন বেগিচ টাওয়ার্স। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারেন না যে পুরো শহরের কার্যক্রম একটা ভবনের ভেতরে চলছে। পর্যটকদের জন্য এখানে কায়াকিং, হাইকিং এবং গ্লেসিয়ার ট্যুরের ব্যবস্থা আছে।
হুইটিয়ারের বাসিন্দাদের কাছে এই জীবন খুব স্বাভাবিক। তাঁরা বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও নিজেদের ছোট্ট জগতে সুখী। তাঁরা জানেন, প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হলে মানুষের একতাই সবচেয়ে বড় শক্তি।
বেগিচ টাওয়ার্স শুধু ইট-পাথরের ভবন নয়, এটি মানুষের অভিযোজন ক্ষমতার এক অনন্য নিদর্শন। পৃথিবীর আর কোথাও হয়তো এমন শহর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেটা আপনি লিফটের বোতাম টিপে ঘুরে আসতে পারবেন!
সূত্র: এনপিআর ও দ্য ইকোনমিক টাইমস