বেলজিয়ামের লুভেন যেন প্রাচীন এক রূপকথার শহর
প্রকৃতির আলিঙ্গনে আবিষ্ট প্রাচীন, তবে আধুনিক এক শহর লুভেন। শহরটি পৃথিবীর অন্যতম গোথিক টাউন হল, ক্যাথেড্রাল আর প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘেরা। গ্রুট বেজিনহজের ছোট ছোট ভবনের মধ্য দিয়ে পথ, যেন অলৌকিক কোনো পুরোনো পরিত্যক্ত শহরের রূপকথার ছবি। তা ছাড়া পুরো শহরটাই যেন এক গা–ছাড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গ্রীষ্মকাল হওয়ায় কিছু পর্যটক আছেন, তবে কারও যেন কোনো তাড়া নেই।
এমন এক শহরে যাওয়ার দিন পড়েছে ভয়াবহ গরম। বেলজিয়ামের আবহাওয়ায় এটা বেশ গরম। এ দেশে সাধারণত গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা থাকে ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। খুব বেশি হলে সেটা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তর সাগরের প্রভাবে দেশটির দক্ষিণ দিকে তাপমাত্রা থাকে আরও কম। কিন্তু সেদিন তাপমাত্রা উঠেছিল ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে!
গায়ে রোদ মাখিয়ে খরতাপেই হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম লুভেন ও এর চারপাশে। এত গরমেও অনীহা কাজ করছিল না। মাঝেমধ্যেই তাপের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু থামতে ইচ্ছে করছিল না।
শহরের পাশেই এক মায়াময় জঙ্গল, যেন চাইলেই হারিয়ে যাওয়ার এক অপূর্ব সুযোগ। গরম থেকে বাঁচারও একটা উপায়। আমার মতো প্রথমবার এই জঙ্গলে ঢুকলে যথারীতি এক গা ছমছমে ভাব হবে, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার অবারিত সুযোগও পাওয়া যাবে।
বনের ভেতর গিয়ে দেখা পেলাম লুভেনের সুখ-দুঃখের নদী ডাইলির। এই নদী জন্মলগ্ন থেকেই লুভেন শহরকে বন্যা দিয়ে কাঁদিয়েছে। তবে শহরের উন্নয়নে অবদানও রেখেছে অনেক। বনের ভেতর নদীর ধারে সুবিশাল সারি সারি গাছ, এলোমেলো দাঁড়িয়ে। তার নিচে একটা বসার বেঞ্চ। সেখানে বসেই লুভেনের গল্প বলতে এই লেখা লিখতে বসে গেলাম।
প্রাচীন ইতিহাস, আধুনিক জীবন ও প্রকৃতির শহর
লুভেন বেলজিয়ামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চলের একটি শহর। এটি লেউভেন নামেও পরিচিত। ব্রাসেলস থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এই শহর যেন প্রাচীন ইতিহাস আর আধুনিক জীবনের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন ঘটিয়েছে। এক লাখের বেশি মানুষের এই শহর একই সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান, একটি প্রাণবন্ত শিক্ষাকেন্দ্র এবং সংস্কৃতির মিলনস্থল।
লুভেনের গল্প শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। এর শত বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয় লুভেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় (কেইউ লুভেন)। এটি শুধু বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই অন্যতম নয়, ইউরোপের অন্যতম সম্মানজনক বিদ্যাপীঠও বটে।
১৪২৫ সাল থেকে এই শহর অবিচ্ছিন্নভাবে এক বিশ্ববিদ্যালয় নগরী হিসেবে যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। ইউরোপের ভাটি অঞ্চল হিসেবে পরিচিত আধুনিক বেনেলাক্স দেশগুলো, অর্থাৎ বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে লুভেনই সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় শহর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই লুভেন শহরকে জ্ঞানচর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
২০২৫ সালে লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০০ বছর পূর্তি হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন ১৯২০ সালে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রায় ৫০০ বছর পর। অন্যদিকে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে ১৯২১ সালে, অর্থাৎ জন্মলগ্নেই প্রথম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হন কমরেড লীলা নাগ।
ঢাকার আরমানীটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেছা গার্লস হাইস্কুল এবং শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা এই নারী ১৯২৬ সালে নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতিচর্চা শুরু করতে ‘দীপালী ছাত্রী সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ফরওয়ার্ড ব্লকের নেত্রী লীলা নাগ বিয়ে করেছিলেন উপমহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত বিপ্লবী অনিল রায়কে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সহশিক্ষার পরিবেশ ছিল না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পিজে হার্টগ লীলা নাগের মেধা ও পড়াশোনার প্রতি একাগ্রতা বিচারে বিশেষ অনুমতি দিয়েছিলেন।
বেলজিয়ামের অন্যতম সুন্দর ভবন
মধ্যযুগে লুভেন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও বস্ত্রশিল্পকেন্দ্র। লুইন নামের একধরনের লিনেন কাপড়ের নামকরণ হয়েছে এই শহরের নাম অনুযায়ী। ফলে লুভেন হয়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ নগরী। শহরের স্থাপত্যে আজও সেই সমৃদ্ধির ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়। এর সবচেয়ে উজ্জ্বল নিদর্শন হলো, লুভেনের টাউন হল এবং সেন্ট পিটার্স চার্চ।
টাউন হলের জটিল নকশা ও অসাধারণ ভাস্কর্য বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। ১৪৩৯ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ১৪৬৯ সালে। এই অনবদ্য গথিক শৈলীর ভবনে ২৩৬টি ভাস্কর্য আছে। তবে ভাস্কর্যগুলো ১৮৫০ সালের পর যুক্ত করা হয়। টাউন হলকে বেলজিয়ামের অন্যতম সুন্দর ভবন হিসেবে গণ্য করা হয়।
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলস থেকে ট্রেনে চেপে একা রওনা দিয়েছিলাম লুভেনের পথে। স্টেশনে নেমে এই টাউন হলের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। প্রচণ্ড গরম পড়ায় রোদে বেশিক্ষণ হাঁটা যাচ্ছিল না। পথে একটা ক্যাফেতে বসে কিছু খাব বলে অর্ডার করতে বসলাম। কিন্তু যে তরুণী খাবারের অর্ডার নিতে এসেছিলেন, ভাষাগত জটিলতায় তিনি ও আমি দুজনই বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। ফরাসি ভাষার লেখা টুকটাক বুঝি, কিন্তু দ্রুত কেউ বলা শুরু করলে আমার দফারফা। এর বাইরে আমার উপায় ছিল ডাচ্ বলা। কিন্তু সেটা আমার আসে না। আর ইংরেজিটা সেই তরুণীর পোষাচ্ছিল না।
অগত্যা সেই তরুণী আমাকে ক্যাফের ভেতর নিয়ে গেলেন স্বচক্ষে খাবার দেখাতে। ইউরোপের ছোট শহরে এই সুবিধা আছে। রাজধানী বা বড় শহরের চেয়ে তুলনামূলক ছোট শহরে ঘোড়দৌড় কম। সেই সুবাদেই ওয়েটার তরুণীর হাতে ব্যয় করার মতো এতটা সময় ছিল, বোঝা যায়।
যাহোক, সেই ক্যাফে থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম টাউন হলের সামনে। চত্বরটাজুড়েই রয়েছে টাউন হল, ক্যাথেড্রাল, চার্চ, বেশ কিছু ক্যাফে আর খাবারের দোকান। গ্রোট মার্ক হিসেবে পরিচিত এই জায়গা শহরের প্রাণকেন্দ্র। সব সময় ক্যাফে, রেস্তোরাঁ ও বারে পরিপূর্ণ থাকে। পাশেই লুভেন ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভবন।
আজও শিক্ষাগত ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত লুভেন। প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী এই শহরে আসেন। তাঁদের তারুণ্যের স্পন্দনে শহরটি সব সময় মুখর থাকে। শহরের পাশে বনের মনোরম পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অনুষদ ও গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে, যা প্রকৃতির মাঝখানে জ্ঞানচর্চার এক বিরল সুযোগ করে দিয়েছে।
বেলজিয়ামের অন্যান্য শহরের মতো এখানেও রয়েছে বাইসাইকেলের চমৎকার সংস্কৃতি। হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলাম ‘বিগ ব্যাং বাইসাইকেল রুট’। আধুনিক বিগ ব্যাং তত্ত্ব দিয়ে বিখ্যাত হওয়া জর্জ লোমাট্রা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, পড়িয়েছেন। ১৮৯৪ সালে বেলজিয়ামের শারলেরই শহরে জন্ম নেওয়া এই ক্যাথলিক পাদরি একাধারে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও গণিতবিদ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্মরণেই বাইসাইকেলের জন্য এই পথ তৈরি করা হয়েছে, যা লোমাট্রার দুটো ভাস্কর্য্যের মধ্যে সংযোগ সৃষ্টি করেছে।
দ্য বেলজিয়ান শিন্ডলার
১৯২৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পড়তে এসেছিলেন কিয়ান ঝাইয়োলিং নামের এক চীনা নারী। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা সুন্দর মানবিক ও সাহসী গল্প। ১৯১৩ সালে চীনের জিয়াংসু প্রদেশে জন্ম নেওয়া এই নারী ‘বেলজিয়ান শিন্ডলার’ নামে পরিচিত। জার্মান শিল্পপতি অস্কার শিন্ডলার নিজে জার্মান নাৎসি দলের নেতা হয়েও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হলোকাস্ট থেকে ১ হাজার ২০০ ইহুদি ধর্মাবলম্বীকে নিজের কারখানায় কাজ দিয়ে তাঁদের জীবন রক্ষা করেছিলেন। ইহুদিদের জীবন বাঁচানোর জন্য তাঁকে নাৎসি দলের লোকদের ঘুষ ও নানা রকম আর্থিক প্রণোদনা দিতে হতো। ১৯৯৩ সালে তাঁর এই মহৎ প্রচেষ্টার গল্প নিয়ে তৈরি হওয়া স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ অস্কারে সেরা সিনেমার পুরস্কারসহ মোট ৭টি পুরস্কার জিতেছিল।
একইভাবে চীনা এই নারী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু বেলজিয়ান নাগরিকের জীবন বাঁচিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালে বেলজিয়ান এক চিকিৎসককে বিয়ে করে তাঁরা হেরবুমো নামক শহরে স্থায়ী হন। ১৯৪০ সালে বেলজিয়ামের এক তরুণ রেললাইনের নিচে মাইন পুঁতে জার্মানির একটি সামরিক রেলগাড়ি উড়িয়ে দেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সে বছর জুন মাসে জার্মান বাহিনী হেরবুমো শহর দখল করে এবং সেই তরুণকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। কিয়ান ঝাইয়োলিং সেই তরুণকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন।
তখন জার্মান জেনারেল ছিলেন আলেক্সান্ডার ভন ফলকেনহজেন। কিয়ান এই জেনারেলকে চিনতেন; কারণ, চীনে থাকাকালীন তিনি চীনা-জার্মান সহযোগিতার অংশ হিসেবে কাজ করেছেন। আর তখন ফলকেনহজেন ছিলেন চীনা জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াং কাইশেকের উপদেষ্টা। সে হিসেবে কিয়ানের এক ভাইয়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন ফলকেনহজেন। আর সেই সুবাদে কিয়ান মানবতার খাতিরে সেই তরুণকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে সফল হন।
কিন্তু কিছুদিন পর পাশের আরেক শহরে নাৎসি জার্মানির গোপন পুলিশ বাহিনী গেস্টাপোর তিন সদস্যকে হত্যার দায়ে ৯৭ জন বেলজিয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেয় জার্মান বাহিনী। কিয়ানের পেটে তখন তাঁর প্রথম সন্তান। সে অবস্থায় তিনি আবারও ফলকেনহজনের কাছে গিয়ে ৯৭ জনের জীবন বাঁচাতে অনুরোধ করেন। শুরুতে রাজি না হলেও জার্মান এই জেনারেলকে শেষমেশ রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিলেন কিয়ান। তবে কিয়ান ঝাইয়োলিংয়ের এই ঘটনা বেশির ভাগ মানুষেরই জানা ছিল না। ২০২১ সালে চীন-বেলজিয়াম কূটনৈতিক সম্পর্কের পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে ঝু ফেঙ এই সাহসী নারীকে নিয়ে প্রথম কোনো বই প্রকাশ করেছেন। বইয়ের শিরোনাম হলো ‘ফরগেট মি: মাদাম কিয়ান ঝাইয়োলিং-দ্য বেলজিয়ান শিন্ডলার’।
বিখ্যাত দারদেনে ব্রাদার্সও লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। সিনেমায়ও তাঁরা প্রায়ই এই শহরকে তুলে ধরেছেন।
বর্তমানে ইউরোপে পড়াশোনা করতে যাওয়ার জন্য ইরাসমাস মুন্ডাস বৃত্তি খুব পরিচিত। এই বৃত্তির নামকরণ হয়েছে যে পণ্ডিতের নামে, তিনি দেসিদেরিয়াস ইরাসমাস। রেনেসাঁর কালে ১৪৬৬ সালে জন্ম নেওয়া ডাচ্ এই মানবতাবাদী পণ্ডিত ছিলেন লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। একই সঙ্গে আধুনিক হিউম্যান অ্যানাটমির জনক আন্দ্রিয়াস ভেসালিয়াসও এখানে শিক্ষকতা করেছেন।
অন্যদিকে, শিক্ষার পাশাপাশি লুভেনের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক জীবন। এখানে রয়েছে বেশ কিছু জাদুঘর, গ্যালারি ও থিয়েটার। সারা বছর নানা উৎসব ও ইভেন্ট স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে।
লুভেনের অন্যতম আকর্ষণ হলো গ্রোট বেজিনার্ড, যা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে একটি। এটি মধ্যযুগীয় ‘বেজিন’ অর্থাৎ ধর্মপ্রাণ নারীদের বাসস্থান ছিল, যাঁরা সন্ন্যাসি না হয়েও সম্মিলিত জীবন যাপন করতেন। সুসংরক্ষিত ঐতিহাসিক ভবন ও সরু রাস্তার এই এলাকায় রয়েছে সুনসান উঠান। এখানকার রাস্তায় হাঁটলে মনে হয় যেন কোনো প্রাচীন নগরীতে হারিয়ে গেছি। সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা, যা ছবি বা ভিডিওতে তেমন বোঝা যায় না।
সুখ-দুঃখের নদী ডাইলি
লুভেন শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ডাইলি নদী। অতীতে এটি লুভেনের বাণিজ্য ও পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ পথ ছিল। মধ্যযুগে লুভেন যখন বস্ত্রশিল্পের কেন্দ্র ছিল, তখন এই নদীর পানিই কলকারখানার চালিকা শক্তি ছিল। নদীপথেই পণ্য পরিবহন করা হতো। শহরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে দারুণ ভূমিকা রেখেছে এই নদী।
লুভেনের পুরোনো এলাকাগুলোয় ডাইলি নদীর উপস্থিতি শহরের স্থাপত্য ও বিন্যাসে গভীর প্রভাব ফেলেছে। নদীর বাঁকে বাঁকে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক ভবন। ফলে এই শহর পেয়েছে এক অনন্য চরিত্র।
ঐতিহাসিকভাবে ডাইলি নদীর কারণে লুভেন বারবার বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। তবে লুভেনে গিয়ে দেখলাম, শহর কর্তৃপক্ষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের দেশে শহরের পাশ দিয়ে নদী গেলেই সেটাকে চিপে মেরে ফেলার প্রতিযোগিতা চলে।
যথেচ্ছার দখলের শিকার হওয়া আর ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হওয়াই যেন আমাদের দেশে শহরের পাশে বয়ে চলা নদীর ‘নিয়তি’। কিন্তু ডাইলি নদীর ক্ষেত্রে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। কিছু স্থানে নদীর ওপর নির্মিত পুরোনো কাঠামো ভেঙে নদীকে উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে বন্যার ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি নদীর আশপাশে মনোরম জনপরিসর তৈরি হয়েছে।
ডাইলি নদী বেলজিয়ামের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। এটি মেখেলেনের কাছে রুপেল নদীর সঙ্গে মিশেছে, যা আবার শ্কেলদে নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে উত্তর সাগরে পতিত হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, ঐতিহাসিক দলিলপত্রে লুভেনের নাম যখন প্রথম পাওয়া যায়, তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এই নদী। খ্রিষ্টাব্দ ৮৮০-এর দশকে ভাইকিংরা এই নদীর পথ ধরেই লুভেনে ক্যাম্প স্থাপন করে। ধারণা করা হয়, সেই ক্যাম্প স্থাপনই লুভেন শহরের গোড়াপত্তন করেছিল, যদিও শহরটি নগরের মর্যাদা পেয়েছিল বারো শতকে একটি পাথরের দেয়াল নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ৮৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভাইকিংদের সঙ্গে পূর্ব ফ্রাঙ্কিয়ার সেই যুদ্ধ ‘ডাইলি নদীর যুদ্ধ’ নামেই পরিচিত।
এই নদীর পাড়ে দীর্ঘক্ষণ বসে এই লেখার খসড়া লিখে বনের ভেতর দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কিছুদূর হেঁটে পাওয়া গেল অ্যারেনবার্গ দুর্গ। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে পিকার্ড (ফরাসি) বংশোদ্ভূত ক্রয়স পরিবার এই দুর্গ নির্মাণ করতে শুরু করে। চমৎকার এই দুর্গ তৈরি হয়েছিল গথিক ও রেনেসাঁ পদ্ধতির নির্মাণশৈলীর মিশেলে। কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে এই দুর্গের মালিকানা চলে যায় অ্যারেনবার্গ পরিবারের কাছে। এই পরিবার ছিল জার্মান বংশোদ্ভূত। আর তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানিসহ অক্ষশক্তির পরাজয় ঘটলে এই দুর্গ বাজেয়াপ্ত করা হয়। তখন অ্যারেনবার্গ পরিবারের কাছ থেকে মালিকানা চলে যায় লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে।
সেই দুর্গের উল্টো পথ ধরে মূল রাস্তা দিয়ে শহরে চলে এলাম। গথিক নকশার সেই টাউন হলের সিঁড়িতে বসে হালকা নাশতা সেরে ব্রাসেলসের উদ্দেশ্যে সেই লুভেন স্টেশনের দিকে দৌড় দিলাম, যেখানে নেমেই পেয়েছিলাম এমন মনোমুগ্ধকর এক শহর।























