তিন অভিবাসীর গড়া সংস্থাটি এখন ১২ হাজার শিক্ষার্থীর ভরসাস্থল
বাইরে স্থায়ী হওয়ার পর অনেকেই নিজের দেশকে ভুলে যান, দ্রুতই নতুন দেশকে করে তোলেন স্বদেশ। কিন্তু সিলিকন ভ্যালির ঝাঁ–চকচকে জীবনও আবু মাহমুদুল হাসান, বাবু রহমান আর সাবির মজুমদারের মন থেকে স্বদেশকে মুছতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই তিন বাংলাদেশি তরুণ প্রকৌশলীর শুধু মনে হতো কীভাবে দেশের জন্য কিছু একটা করা যায়। এই ভাবনা থেকেই নিজেদের পকেট থেকে ৫০০ ডলার করে তুলে কুমিল্লার লাকসামের গণ–উদ্যোগ বালিকা বিদ্যালয়ে ল্যাব প্রতিষ্ঠার জন্য অনুদান পাঠান। ২০০৩ সালের সেই ক্ষুদ্র উদ্যোগই পরে ‘আগামী’ নামে হাজারো শিক্ষার্থীর নির্ভর হয়ে ওঠে। তিন অভিবাসীর প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা সংস্থাটি আজ ১২ হাজারের বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের ভরসাস্থল। এ জন্য কাজ করছেন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শত শত স্বেচ্ছাসেবক।
যুক্তরাষ্ট্রে বেড়াতে গিয়ে নর্থ ক্যারোলাইনার একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে এই তিন কান্ডারির একজনের সঙ্গে পরিচয় ও আলাপ হলো। তিনি সাবির মজুমদার। আগামীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও বোর্ড সদস্য। তিনি বলেন, ‘সিলিকন ভ্যালিতে আমাদের শিকড়। পরিবেশবান্ধব আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পক্ষে আমরা। আমাদের আশা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা যেন আধুনিক শিক্ষার সুযোগ পায়। শুধু বই বা খাতা দেওয়া নয়, আমরা আসলে শিশুদের সম্ভাবনার দুয়ারটা খুলে দিতে চাই।’
আগামীর ওয়েবসাইট ও বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানলাম, ২০০৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত সংস্থাটি যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ইউএস-আইআরএস অনুমোদিত দাতব্য প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশে এর সহযাত্রী সংগঠন ‘আগামী এডুকেশন ফাউন্ডেশন (এইএফ)’ সরকারিভাবে নিবন্ধিত ও করমুক্ত অনুদানের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লাইসেন্সপ্রাপ্ত।
ঢাকা, সিলেট, ঝিনাইদহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা, খাগড়াছড়ি, নাটোর, টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, নড়াইল জেলার ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক, খাতা, ইউনিফর্ম, স্টেশনারি, শিক্ষকের বেতন ও প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল শিক্ষা উপকরণ (কম্পিউটার, ইন্টারনেট), পুষ্টিকর টিফিন, চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে ‘আগামী’। স্কুলগুলোর শ্রেণিকক্ষ, টয়লেট, টিউবওয়েল ইত্যাদি অবকাঠামো উন্নয়নেও কাজ করা হচ্ছে। শিক্ষার মান রক্ষায় শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে ‘আগামী’। শেখায় গণিত ও বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয় সহজভাবে শেখানোর কৌশল। বিশেষ প্রয়োজনে ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে শিক্ষকও নিয়োগ করে।
আগামীর সহায়তা পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার স্বপ্ননগর বিদ্যানিকেতন। বন্ধ হয়ে যাওয়া পটিয়া চা-বাগানের পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরিঘরের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে স্কুলটি তৈরি করা হয় ২০০৯ সালে। আগে সেখানে কোনো স্কুল ছিল না। চা–বাগানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের জন্য স্কুলটি তৈরি হলেও পাশের এক কিলোমিটার দূরের আদর্শগ্রাম থেকে আসে এর ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী। আদর্শগ্রামেও কোনো স্কুল নেই। এখন শিশুশ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীসংখ্যা ১৪৬। সুন্দর সাংস্কৃতিক আবহে শিক্ষা পাচ্ছে এসব শিশু। গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কনসহ নানাভাবে শিশুরা এখানে তাদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে। বছরজুড়ে নানা আয়োজনে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাজগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা এখানে এসে মুগ্ধ হন। স্কুলটির আট সমন্বয়কারীর একজন ধ্রুবজ্যোতি হোর জানান, আগামীর কাছ থেকে শিক্ষা সরঞ্জামসহ নানা সহায়তা পেয়ে থাকেন তারা। বলেন, ‘বছরে দুবার স্কুলের কার্যক্রম দেখতে আসেন আগামীর কর্মকর্তারা। একবার নোটিশ দিয়ে আসেন। আরেকবার সারপ্রাইজ ভিজিট।’
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ১৫ বছরে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে তারা। অ্যানুয়াল ফান্ড রেইজিং ইভেন্ট, করপোরেট ম্যাচিং গিফট, সদস্য ফি ও জনসাধারণের অনুদান, ই–মেইল এবং অনলাইন ক্যাম্পেইন ও নির্দিষ্ট প্রকল্পভিত্তিক দানের মাধ্যমে তারা এই তহবিল সংগ্রহ করে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এসব কার্যক্রম চালাতে কোনো প্রশাসনিক খরচ করেনি তারা। তবে ২০১১ থেকে ঢাকায় একটি অফিস চালু করে, সেই অফিসের প্রশাসনিক খরচও ১৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে।
আগামীর কাজ সম্পর্কে সাবির মজুমদার বলেন, ‘আমাদের কাজ দুই ধরনের। প্রথম কাজটি হলো বছরজুড়ে তহবিল সংগ্রহ। আর দ্বিতীয় কাজ হলো সংগৃহীত অর্থ দিয়ে “স্কুল প্রোগ্রাম”সহ অন্যান্য প্রকল্প পরিচালনা। শুরু থেকেই স্কুল প্রোগ্রাম আমাদের মূল কার্যক্রম।’ গত ১০ বছরে আরও ৮টি সাপোর্টিং প্রোগ্রাম, প্রকল্প ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্কুল প্রোগ্রাম চালানোর জন্য তাঁরা এমন স্কুল বেছে নেন, যেখানে সরকারি বা এনজিওর সহায়তা নেই বললেই চলে এবং যেগুলোর শিক্ষার্থীরা আর্থসামাজিকভাবে দুর্বল। প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময় কঠোরভাবে ধর্ম ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয় বলে তিনি জানান।
সিলিকন ভ্যালির আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকা কিছু মানুষের এই উদ্যোগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ভৌগোলিক দূরত্ব কখনো মাতৃভূমির মায়ার বন্ধনকে ছিন্ন করে না।