বাংলা লেখার ভুল শুধরে দেবে ‘সঠিক এআই’

সঠিক এআই’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান হাবীব এবং সহপ্রতিষ্ঠাতা আর টি বি রুহান
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ইংরেজি বানান বা ব্যাকরণগত ভুল শুধরে দিতে বেশ কিছু সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইট আছে। বাংলায় কেন নেই? এ প্রশ্নটিই এসেছিল একদল তরুণের মাথায়। ‘সঠিক এআই’ তাঁদেরই উদ্যোগ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ব্যবহার করে যেন সহজ ও নির্ভুলভাবে বাংলা লেখা যায়, সেটিই নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তাঁরা।

এই ‘তাঁরা’ আসলে কারা?

‘সঠিক এআই’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান হাবীব নিউক্যাসেল ল একাডেমি থেকে আইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করেছেন। পরে যুক্তরাজ্যের সাউথ টেমস কলেজ থেকে ৬ লেভেলের স্নাতক সম্পন্ন করেন; বিষয় ছিল ব্যবসা ব্যবস্থাপনা। সহপ্রতিষ্ঠাতা (সিটিও) আলমগীর আহমেদ গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে স্নাতক করেছেন। আরেক সহপ্রতিষ্ঠাতা আর টি বি রুহান (সিওও) আহ্‌ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন

যে উদ্যমে শুরু

আগারগাঁওয়ের আইসিটি টাওয়ারে বসে ‘সঠিক এআই’-এর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল গত ২৯ জানুয়ারি। আহসান হাবীব বলছিলেন প্রকল্পের শুরুর দিকের কথা, ‘আমি যখন স্টুডেন্ট, তখন ইংরেজি লেখার জন্য বিভিন্ন টুলস ব্যবহার করতাম। কিন্তু শুদ্ধ বাংলা লিখতে সাহায্য করবে, সে রকম ভালো কিছু পাইনি। আবার দেখা যেত ইংরেজি লেখার বেশির ভাগ সফটওয়্যারই বিদেশি। তাই পেমেন্ট করতে সমস্যা হতো। তখনই অনুধাবন করি, এ সমস্যাটা শুধু আমাদের নয়। দুই বাংলার সাধারণ মানুষ ছাড়াও লেখালেখি ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরাও নিশ্চয় এ সমস্যায় পড়েন। সমাধান খোঁজার চিন্তা থেকেই আমি ও বন্ধু আলমগীর আহমেদ মিলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে কিছু উদ্ভাবনের চেষ্টা করতে থাকি। পরে আমাদের সঙ্গে রুহান যোগ দেয়।’

বিগ থেকে বড় অনুপ্রেরণা

২০২১ সাল থেকে পুরোদমে কাজ শুরু করে এই স্টার্টআপের দল। একসময় পুরো প্রকল্প সাজিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্র্যান্ট’ (বিগ) ২০২৩-এ অংশ নেয় তারা। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ইনোভেশন ডিজাইন অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ একাডেমি (আইডিইএ) এই প্রতিযোগিতার আয়োজক।

কয়েক ধাপ পেরিয়ে বিগের সেরা ৫০-এ জায়গা করে নেয় ‘সঠিক এআই’। সেই সুবাদেই তরুণ এই উদ্যোক্তারা জিতে নেন ১০ লাখ টাকার অনুদান। আহসান হাবীব বলছিলেন, ‘বিগ থেকে বড় অর্জন ও প্রাপ্তি হলো বুট ক্যাম্পের অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সেখানে বিভিন্ন উদীয়মান কোম্পানির সিইওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ হয়েছে। শুধু অনুদান নয়, ঠিকঠাক কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটা ভালো অফিস পেয়েছি। এটাও আমাদের পথচলায় বড় একটা ভূমিকা রেখেছে।’ সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে পাওয়া নানা কারিগরি সুযোগ-সুবিধা এই তরুণ দলকে আরও অনুপ্রাণিত করেছে।

‘সঠিক ডট এআই’–তে যা থাকছে

সহজ করে বললে বাংলা বানান ও ব্যাকরণের ভুল শুধরে দেওয়াই সঠিক এআই–এর কাজ। তবে সঠিক ডটএআই (shothik.ai) ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারলে দেখতে পাবেন আরও বেশ কিছু সেবা দিচ্ছে তারা। যেমন একটি বাক্য ভিন্ন ভিন্নভাবে লেখা (প্যারাফ্রেজিং), বড় একটি লেখার সারাংশ তুলে আনা (সামারাইজিং) ইত্যাদি। নতুন আরও কিছু সেবা নিয়েও কাজ করছে ‘সঠিক’। আহসান হাবীব বলেন, ‘অনুবাদ, টেক্সট টু ইমেজ এবং ভিডিও জেনারেশনের মতো আধুনিক সুবিধাগুলোও ধীরে ধীরে চালু হবে। এ ছাড়া ব্যবহারকারী নিজের পছন্দমতো একই লেখা নানাভাবে সাজিয়ে নিতে পারবেন আমাদের এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে।’

গুগল ও অ্যামাজনের সহায়তা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংক্রান্ত কাজগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে নানা রকম তহবিল দেয় বিশ্বের নামী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো। সে রকমই একটি সুবিধা পেয়েছেন বাংলাদেশের এই তরুণেরাও। স্টার্টআপ প্রোগ্রামের অধীনে অ্যামাজন থেকে ১ লাখ মার্কিন ডলার ও গুগল ক্লাউড থেকে সাড়ে ৩ লাখ মার্কিন ডলার সমমূল্যের সেবা গ্রহণ করতে পারবে সঠিক এআই।

আরেকটু বুঝিয়ে বললেন আর টি বি রুহান, ‘যেহেতু আমাদের পুরো অবকাঠামো ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা, তাই আমাদের প্ল্যাটফর্ম উন্নয়নে ও ক্লাউড বিলিংয়ের জন্য এ টাকাটা খরচ হবে। অ্যামাজন ও গুগলের এই ফান্ডের মাধ্যমে আমরা দেশের বাইরেও আমাদের সেবার পরিধি বিস্তৃত করতে পারব। তা ছাড়া গুগলের সহায়তায় আমাদের প্ল্যাটফর্মে আরও নতুন ও আধুনিক এআই টুলস যোগ করতে পারব।’

সামনের পরিকল্পনা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর শিক্ষা প্রযুক্তি শিল্প (এড টেক ইন্ডাস্ট্রি) দিন দিন আরও বড় হচ্ছে। প্রায় ৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই বিশাল বাজারের একটা অংশই নিজেদের দখলে নিতে চান সঠিক এআই-এর উদ্যোক্তারা। সহপ্রতিষ্ঠাতা আলমগীর আহমেদ বললেন তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা, ‘স্থানীয় কোনো কোম্পানি কিন্তু এ–সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে এখনো সেভাবে কাজ করছে না। অথচ বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে লাখো মানুষ গ্রামারলি, কুইলবট, টেক্সট টু ইমেজ, টেক্সট টু ভিডিও সেবার জন্য গুগলে সার্চ করে। যেহেতু বাংলায় আমরা এ ধরনের সেবা দেওয়া শুরু করছি, আশা করি দেশে ও বিশ্ববাজারে নিজেদের কাজ দিয়ে একটা অবস্থান তৈরি করতে পারব।’

আইসিটি বিভাগের আইডিইএর সিনিয়র পরামর্শক ও হেড অব অপারেশনস সিদ্ধার্থ গোস্বামীও এই স্টার্টআপ নিয়ে আশাবাদের কথাই বললেন। তাঁর মতে, ‘বিগের সেরা ৫০-এর প্রতিটি দলই অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। নিজ যোগ্যতা বলেই তারা এই অনুদান পেয়েছে। বিশেষ করে, “সঠিক এআই”–এর ক্ষেত্রে বলতে পারি, লেখালেখিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার নিয়ে খুব বেশি মানুষ এ দেশে কাজ করছে না। ওরা যেহেতু বাংলার জন্য এটা করছে, তাই যুগান্তকারী কিছু হবে বলেই আমার বিশ্বাস।’

২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখে ‘সঠিক এআই’–এর বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে। ১৫০ শব্দ পর্যন্ত বিনা মূল্যে সেবা পেলেও সব সুবিধা নিতে ২৫০ টাকা ও ৭৫০ টাকার দুই ধরনের প্যাকেজ রাখার কথা জানিয়েছেন নির্মাতারা।