এমনও সময় ছিল, তিনটি চাকরি একসঙ্গে সামলেছি
ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) হায়দরাবাদে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন মো. আবুল হাসানাত। স্নাতক করেছেন ঢাকার প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে। পরে ঢাকা থেকে নিয়মিত গাজীপুরের ডুয়েটে যাওয়া–আসা করতে হয়েছে মাস্টার্সের জন্য। কখনো কোচিংয়ে, কখনোবা কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ছোট ছোট পদক্ষেপ কীভাবে তাঁকে গবেষক হওয়ার স্বপ্ন দেখাল? সে গল্পই লিখেছেন তিনি।
তখন প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির পুরকৌশল বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়ি। ঢাকায় একটা কোচিং সেন্টারে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও গণিত পড়াতাম। ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থীর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা বেশ উপভোগ করতাম। ক্যারিয়ার নিয়ে কী করা যায়, প্রতিদিনই নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হতো।
প্রকৌশল পড়তে গিয়ে বুঝলাম, কেবল জ্ঞান অর্জন করলেই হবে না, এর প্রয়োগ জানাটা আরও জরুরি। স্নাতক শেষ হওয়ার প্রায় দুই মাস আগেই ঢাকা ওয়াসার একটি প্রকল্পে জুনিয়র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দিই। মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করি বছরখানেক। শহরের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মতো জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে উপলব্ধি হলো, প্রতিটি সমস্যা আসলে নতুন কিছু শেখার সুযোগ।
ঢাকা ওয়াসার প্রকল্পে আমার যাঁরা সহকর্মী ছিলেন, চাকরির পাশাপাশি তাঁরা কেউ বিসিএস, কেউবা বিদেশে পড়ালেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নিজের ফার্ম খোলার পরিকল্পনাও ছিল কারও কারও। স্নাতকোত্তরের জন্য আমি ভর্তি হয়ে যাই ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট)। শুরু হয় আরেক পথচলা। ‘পথচলা’ বলতে আক্ষরিক অর্থেই ‘পথচলা’। কেননা, বাসে করে গাজীপুর যাওয়া-আসা তখন বিরাট ঝক্কির কাজ। বলছি ২০১৭-১৮ সালের কথা। তখন মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়েসহ নানা কাজ চলছে। যানজটে বসে থাকতাম আর বাসের জানালা দিয়ে হাজারো মানুষের ব্যস্ততা দেখতাম।
বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক গণেশচন্দ্র সাহা আমার মাস্টার্সের সুপারভাইজার ছিলেন। কো-সুপারভাইজার ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান, তিনি একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের হর্টিকালচার বিভাগে ছিলেন। তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই আমি হবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ শুরু করি। ধীরে ধীরে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, টেকসই উন্নয়ন, দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করতে লাগলাম। যদিও স্নাতকে আমার মেজর ছিল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহটা তখনো যায়নি। তাই ডুয়েটে পড়া অবস্থাতেই দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। শিক্ষকতার সুযোগ অবশ্য যখনই এসেছে, তখনই কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, বিএএফ শাহীন কলেজ কুর্মিটোলায় কাজ করার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছে। এমনও সময় ছিল, যখন তিনটি চাকরি একসঙ্গে সামলেছি—যদিও সেটা মাত্র এক বছরের জন্য।
সিদ্ধান্ত নিই, পিএইচডি করব। পুরকৌশলেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আবেদন করি। সুযোগ হয়েও যায়। এখানে আমার সুপারভাইজার ছিলেন অধ্যাপক আশরাফ আলী, তিনিও বেশ স্বনামধন্য। মজার ব্যাপার হলো, তিনি ছিলেন আমার মাস্টার্সের সুপারভাইজারের সুপারভাইজার।
এরই মধ্যে ভারতের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি পেলাম। তাই বুয়েট থেকে চলে এলাম আইআইটি হায়দরাবাদে। এখন আমি পিএইচডির প্রায় শেষের দিকে আছি। এখানে শিক্ষকের সহায়তাকারী (টিচার্স অ্যাসিস্ট্যান্ট) হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে গবেষণার খুঁটিনাটিসহ নানা কিছু শিখিয়েছে। আমার অধ্যাপক পৃথা চ্যাটার্জি প্রায়ই ক্লাস নেওয়ার দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দেন। ঘুরেফিরে সেই শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাই আমি উপভোগ করি।
২০২৪ সালে আইআইটি হায়দরাবাদের অর্থায়নে গ্রিস, জার্মানি ও ভারতের তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার চারটি গবেষণা উপস্থাপন করেছি। যার একটি থেকে এসেছে ‘সেরা গবেষণা পোস্টার’–এর পুরস্কার। এভাবে ছোট ছোট পদক্ষেপে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। সামনে আরও অনেক দূর যাওয়ার ইচ্ছা।