মরদেহ হস্তান্তরের সময় অভিভাবকের জায়গায় লেখা হলো আমার নাম
উত্তরায় মাইলস্টোনের একাধিক ক্যাম্পাস আছে। যে ক্যাম্পাসে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে, সেখান থেকে আমার ক্যাম্পাস প্রায় এক কিলোমিটার। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরে আমাদের কোচিং চলছিল। হঠাৎ কো–অর্ডিনেটর সাবরিনা রহমানের ডাক। নিচে নামতেই জানালেন, দিয়াবাড়ির স্কুল ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে।
বাচ্চাদের কথা ভেবে হাত-পা অবশ হয়ে আসে। কী করব ভেবে উঠতে পারছিলাম না। আমাদের উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টর ক্যাম্পাসের কাছেই শিন-শিন জাপান হাসপাতাল। হতাহত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য সেখানে আনা হয়েছে শুনে ছুটে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মর্মান্তিক অবস্থা। অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে একেকজন। অনেকেরই অভিভাবক তখনো আসেনি। এক শিক্ষার্থীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে পাশে দাঁড়াই। একটু পর ছেলেটার বোন এলে তাকে বুঝিয়ে দিয়ে অন্যদিকে যাব ভাবছি। তখনই পাশে দেখি, প্রাইমারি শাখার বাংলা মাধ্যমের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মাসুকা বেগম। আগুনে তাঁর সারা শরীর পুড়ে গেছে। তাঁর পাশে কেউ নেই। চিকিৎসক পরামর্শ দিলেন, ম্যাডামকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিতে হবে। দ্রুত বাসায় গিয়ে কিছু টাকাপয়সা নিয়ে আবার হাসপাতালে আসি। তারপর অ্যাম্বুলেন্সে ম্যাডামকে নিয়ে ছুটি বার্ন ইনস্টিটিউটে।
এখানকার চিত্র আরও ভয়াবহ। আহত শিক্ষার্থীরা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাতরাচ্ছে। পাশে তাদের অসহায় মা-বাবা কাঁদছেন। ভিড় ঠেলে লিফটে করে মাসুকা ম্যাডামকে নিয়ে চতুর্থ তলায় উঠি। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকেই সেখানে আগে থেকেই ভর্তি। চিকিৎসকেরা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের সহযোগিতায় মাসুকা ম্যাডামকে দ্রুতই ড্রেসিংরুমে নেওয়া হয়।
আমি আইসিইউর সামনের ছোট্ট জায়গাটায় বসে পড়ি। বাচ্চাদের কী অবস্থা, দুজন ম্যাডামের কী অবস্থা—এসবের খোঁজ রাখছি আর অন্যদের জানাচ্ছি। এই কাজ করতে করতে একসময় খেয়াল করলাম, আমি অনেকটা স্ট্যাচুর মতো ঠায় বসে আছি।
রাত ১০টার দিকে মাহরীন চৌধুরী ম্যাডাম মারা গেলেন। মাসুকা ম্যাডামের অবস্থাও ক্রমে খারাপ হচ্ছিল। একপর্যায়ে উপস্থিত শিক্ষকদের কাছে ডেকে তিনি বললেন, ‘আমার তো এখানে কেউ নেই। আপনারাই আমার ভাই-বোন। দাফন-কাফন আপনারাই করবেন। আমাকে কলেমা পড়িয়ে দিন।’
তাঁর কথা শুনে ভেতরটা ভেঙে গেল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আমরা কালেমা পড়ালাম। তার দুই ঘণ্টার মাথায় তিনিও পরপারে পাড়ি জমালেন।
তখনো তাঁর পরিচিত কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো অভিভাবকের হদিস না মেলায় মরদেহ নিয়ে জটিলতায় পড়লাম। ক্যাম্পাস তত্ত্বাবধায়ক অভয় দিয়ে বললেন, ‘আমরা তো আছি, কোনো না কোনো সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারব।’
কিছুক্ষণ পরই আবার তত্ত্বাবধায়কের ফোন। গ্রাম থেকে মাসুকা ম্যাডামের পরিচিত কেউ একজন ঢাকায় আসছেন। দেরি না করে হাসপাতালের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করি। তাঁর মরদেহ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হলো। হাসপাতালের সেসব ডকুমেন্টে অভিভাবক হিসেবে লেখা হলো আমার নাম।
অনুলিখন: এম এ হান্নান