জাহাঙ্গীরনগরের এই এক বিভাগ থেকেই ২ বছরে বিদেশে বৃত্তি পেয়েছেন প্রায় ৩০ জন

এই বিভাগ থেকে ডিগ্রি নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীই বৃত্তিসহ পড়তে যাচ্ছেন বিদেশে
ছবি: সংগৃহীত

বয়স খুব বেশি নয়। ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ। গত দুই বছরে এই বিভাগের প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী বৃত্তিসহ বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড, কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও আছেন কেউ কেউ। তুলনামূলক নতুন এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা কীভাবে বিশ্বের নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পা রাখতে শুরু করলেন?

করোনার প্রভাব

করোনা মহামারির সময়টাতেই মূলত পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্য বিষয়টির গুরুত্ব সবার চোখে ধরা পড়তে শুরু করে। এ ধরনের বিষয় যে বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও অর্থনৈতিক অবস্থার দেশের জন্য আরও জরুরি, তা-ও এখন স্পষ্ট।

করোনার সময়ে যখন দীর্ঘদিন ক্যাম্পাস বন্ধ ছিল, এই মহামারির প্রভাব নিয়ে বিভাগের শিক্ষার্থীরা নানামুখী গবেষণার কাজ করেছেন। এসব গবেষণাই মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগের জানালা খুলে দিয়েছে। বিভাগের অধ্যাপক তাজউদ্দিন সিকদার বলেন, ‘২০২১ সাল থেকে আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিদেশে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। করোনার কারণে সারা পৃথিবীরই শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারকেরা জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছেন। আবার মহামারির কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তির শর্তাবলিতেও কিছু ছাড় দিয়েছে। পাশাপাশি করোনা মহামারিসহ বাংলাদেশের সমসাময়িক জনস্বাস্থ্য ইস্যু নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু বিশ্বমানের গবেষণা করেছে। এটিও তাদের সাহায্য করেছে।’

আরও পড়ুন

স্নাতক পর্যায়েই গবেষণায় মনোযোগ

নতুন বিভাগ হওয়ায় শুরুর দিকে এই বিভাগের অনেক শিক্ষার্থীই ক্যারিয়ার নিয়ে কিছুটা হতাশায় ছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে চিত্রটা অনেকটাই পাল্টে গেছে। কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩তম আবর্তনের শিক্ষার্থী রুম্পা সরকারের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের খ্যাতনামা ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা অ্যাট চ্যাপেল হিলের গিলিং স্কুল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথের অধীনে পিএইচডি করছেন। রুম্পা বলেন, ‘একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়েই গবেষণায় যুক্ত হয়েছিলাম। বিভাগের শিক্ষকদের একটা ভূমিকা ছিল। আমি যখন আবেদন করি, তত দিনে পাঁচটি পিয়ার রিভিউড জার্নালে আমার গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। এটাই এগিয়ে রেখেছে।’

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল কলেজ অব উইসকনসিনের এপিডেমিওলজি বিভাগে জনস্বাস্থ্যের ওপর পিএইচডি করছেন শরীফ হোসেন। তিনিও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই যুক্ত হন গবেষণায়। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিভাগের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ এখন গবেষণা করছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে আসছেন। বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন দেশে-বিদেশে এক হয়ে গবেষণা করা এবং উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে যাওয়ার একটা সুস্থ প্রতিযোগিতা হচ্ছে।’

এমন সাফল্য আমাদের জন্য গর্বের। এই বিভাগের প্রথম শিক্ষক হিসেবে আমার ভালো লাগাটা আরও বেশি। আমরা শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের এই যাত্রায় যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতেও সেটা অব্যাহত রাখব, তার পাশাপাশি সংখ্যাটা যেন আরও বাড়ে, সেই চেষ্টাও করব।
মাহফুজা মোবারক, সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক, পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ

হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজ, সবখানে বিচরণ

২০২৩ সালে বিভাগের প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজসহ বিশ্বের স্বনামধন্য বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২০২৪ সালেও সংখ্যাটা ১০ ছাড়িয়েছে। তাঁদের মধ্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগে সুযোগ পেয়েছেন আফিফা আনজুম। তিনি বলছিলেন, ‘যখন দেখি আমার সিনিয়র, জুনিয়র, ব্যাচমেটরা বেশ ভালো ভালো জায়গায় বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করছে, খুব ভালো লাগে। নিজেদের আসলে জায়গাগুলো তৈরি করে নিতে হয়েছে। কেননা আমরা যারা প্রথম দিকের ব্যাচ, আমাদের গাইড করার মতো তেমন কেউ ছিল না। বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে, প্রথমে নিজের লক্ষ্যটা ঠিক করে নিয়ো। যে লক্ষ্য তোমাদের পথচলায় সাহায্য করবে। আর যেকোনো প্রয়োজনে সিনিয়রদের সাহায্য নেওয়ার সুযোগ তো আছেই।’

আরও পড়ুন

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘অফার লেটার’ পাওয়া মোহাম্মদ এ মামুনও মনে করেন, বিভাগের এগিয়ে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ গবেষণা। তিনি বলছিলেন, ‘জনস্বাস্থ্য একটি অপার সম্ভাবনাময় বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে এক বছর পড়ার পরে আমি এখানে চলে আসি। জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার সুযোগ অনেক বেশি। গবেষণা যেহেতু উচ্চশিক্ষায় অনেক সাহায্য করে, তাই অন্য যেকোনো বিভাগের তুলনায় জনস্বাস্থ্যর শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আছে বলে মনে করি।’

এ বছর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশ্যাল অ্যান্ড বিহেভিয়ারাল সায়েন্সে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পাওয়া ফিরোজ আল মামুন বলেন, ‘আমাদের বিভাগের শিক্ষকেরা অনেক শিক্ষার্থীবান্ধব। সবাই গবেষণায় উৎসাহ দেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বা বিভাগে এমনটা দেখা যায় না।’