আইইউবির উপাচার্য: উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে অভূতপূর্বভাবে

পড়ুন ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) উপাচার্য তানভীর হাসান–এর সাক্ষাৎকার

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (আইইউবি) উপাচার্য তানভীর হাসানছবি: সংগৃহীত

৩৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। এরপর দেশে ফিরে আইইউবিতে যোগ দিলেন। এই সময়ে বাংলাদেশ কতটুকু পাল্টেছে?

আমূল পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। একটু-আধটু নয়, বড় ধরনের পরিবর্তন, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘জায়ান্ট লিপ’। আমি যে বাংলাদেশে জন্মেছি এবং বড় হয়েছি, সেই বাংলাদেশে মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। কিন্তু এখন বাংলাদেশের মানুষের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আছে। একটা সময় ছিল যখন দেশে হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেখানে আসনসংখ্যা ছিল সীমিত। এখন দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। যে কারণে শিক্ষার্থীদের সুযোগ বেড়েছে—নিজেদের পছন্দের জায়গাটি তারা বেছে নিতে পারছে। শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণও অনেক বেড়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি ভালো ফল করছে। আইইউবির কথাই যদি চিন্তা করি, আমাদের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৪৩ শতাংশ নারী। সর্বশেষ যে ব্যাচটি ভর্তি হয়েছে, সেখানেও ৪৯ শতাংশ নবীন শিক্ষার্থী নারী। অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের যে লক্ষ্য আমরা ঠিক করেছি, তা অর্জন করতে হলে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে নারীদের সমান অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। ফাইন্যান্সের অধ্যাপক হিসেবে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারি যে এই ৩৪ বছরে দেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা কমেছে। অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে; যা আমার কাছে একটা অকল্পনীয় ব্যাপার। যার প্রভাবে কর্মসংস্থান বেড়েছে। প্রথাগত কাজের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং বা স্টার্টআপের মতো অনেক বিকল্প কর্মসংস্থানের দিকে নতুন প্রজন্ম ঝুঁকছে। মানসিকতায়ও বড় পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় ছিল যে সামাজিক অবস্থানের কারণে অনেকে অনেক রকম কাজ করতে চাইত না, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই ভয়ে। কিন্তু সেই ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। এখন আমি অনেক তরুণ শিক্ষার্থীকে দেখি নানা রকম কাজ করছে।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার মান নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এ ক্ষেত্রে আইইউবিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

গবেষণাকে আইইউবি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আইইউবি গবেষণার জন্য প্রায় সাত কোটি টাকা অনুদান দিয়েছে। পাশাপাশি গত তিন বছরে গবেষণার জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রায় ৩২.৩ কোটি টাকা অনুদান পেয়েছে আইইউবি। আমাদের শিক্ষকেরা এই সময়ে প্রায় ৮০০ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। আইইউবিতে এখন জলবায়ু পরিবর্তন, রোবোটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, মানসিক স্বাস্থ্য, ফার্মাকোলজি, বিলুপ্তপ্রায় ভাষা—এ ধরনের যুগোপযোগী বিষয় গবেষণা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য গবেষক ও বিজ্ঞানীরা নিয়মিত আইইউবিতে আসছেন। আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে গবেষণার কাজে।

আপনি দেশে স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার পাশাপাশি অধ্যাপনাও করেছেন। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিশ্বমানের কতটুকু কাছাকাছি?

যেমনটা প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলেছি—উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে অভূতপূর্বভাবে। তবে বিশ্বমানের কাছাকাছি যেতে হলে আমাদের আরও অনেক উন্নতি করতে হবে। আশার কথা হলো প্রতিনিয়তই শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং সংযোজন হচ্ছে। সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও অনেক কাজ করছে উচ্চশিক্ষা খাতকে সামনে এগিয়ে নিতে।

উচ্চশিক্ষা বিষয়ে আপনার দর্শন কী?

শিক্ষা হতে হবে এমন, যা শিক্ষার্থীদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, বরং তাদেরকে মুক্তচিন্তার পথ দেখাবে, তাদের চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করবে।

আইইউবির সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা কোনটি?

আইইউবিতে আমরা চারটি কৌশলগত বিষয়ে গুরুত্ব দিই। প্রথমত, আমরা চেষ্টা করি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে উদার কলা বা লিবারেল আর্টসের দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করে দিতে। শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমরা তাদের আগ্রহী করার চেষ্টা করি। অ্যাপলের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস রিড কলেজে যে ক্যালিগ্রাফি এবং টাইপোগ্রাফি শিখেছিলেন, সেই জ্ঞানকেই তিনি প্রযুক্তি খাতে কাজে লাগিয়েছিলেন। সুতরাং লিবারেল আর্টসকে গুরুত্ব দিতেই হবে, আপনি যে বিষয়েই পড়ুন না কেন। দ্বিতীয়ত, আইইউবিতে আমরা সবার জন্য কম্পিউটার কোডিং শেখা বাধ্যতামূলক করেছি। একজন শিক্ষার্থী যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল পেতে হলে কম্পিউটার ব্যবহারে তাকে পারদর্শী হতেই হবে। তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের আমরা বৈশ্বিকভাবে সচেতন করে গড়ে তোলার চেষ্টা করি। বৈশ্বিক রাজনীতি, অর্থনীতি, উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমরা তাদের সম্যক ধারণা দিই। পাশাপাশি তাদের জন্য আমরা কোরিয়ান, ম্যান্ডারিন, ফরাসি এবং স্প্যানিশ ভাষা শেখার ব্যবস্থা করেছি, যেন ভবিষ্যতে দেশের বাইরে গিয়ে তারা সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। চতুর্থত, আমরা তাদের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ে সচেতন করে গড়ে তুলছি। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অবদান খুবই কম। কিন্তু এর কুফল আমরাই সবচেয়ে বেশি ভোগ করি। তাই আমরা চাই, আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন জলবায়ু বিষয়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয় ও পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হয়। এই চারটি বিষয়কে আমরা বলছি আইইউবির চার স্তম্ভ বা ‘দ্য ফোর পিলারস অব আইইউবি’। এটিই আইইউবির সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা।

পাঁচ বছর পর আইইউবিকে কোথায় দেখতে চান?

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পথ ধরে আইইউবিকে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দেখতে চাই। পাশাপাশি বৈশ্বিক পর্যায়েও আইইউবির সম্মানের জায়গা তৈরি করতে চাই। সে জন্য আমরা শিক্ষকদের ভালো মানের গবেষণা করতে উৎসাহ দিচ্ছি এবং ভালো মানের শিক্ষার্থী ভর্তি করছি। একই সঙ্গে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক র‍্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান উন্নত করতে এবং বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অ্যাক্রেডিটেশন অর্জনের জন্য আমরা কাজ করছি।