দেশে বিপন্ন একটি মাছের বিস্তৃত তথ্য আছে এই গবেষকের কাছে

প্রতি বাংলা নববর্ষের মতো ১৪৩১ সনেও দেশের ক্রীড়া, চলচ্চিত্র, ডিজিটাল মঞ্চ, ব্যবসা, গবেষণাসহ নানা ক্ষেত্রের তরুণ প্রতিভাবানদের নিয়ে হাজির হয়েছে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’। বিশেষ এই আয়োজনে গবেষক আলিফা বিনতে হককে নিয়ে লিখেছেন প্রথম আলোর ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও যুব কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মুনির হাসান

গবেষক আলিফা বিনতে হক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কক্সবাজারের দক্ষিণে এবং সোনাদিয়া দ্বীপের আশপাশে হাঙর (শার্ক) আর শাপলাপাতা (রে) মাছের আনাগোনা আছে। ২০১৭ সালে এসবের তথ্যভান্ডার গড়ার কাজ শুরু করেন আলিফা বিনতে হক। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। জেলেরা তাঁকে নিতে চাইছেন না। জেলেদের বিশ্বাস, ‘নৌকায় মহিলা থাকলে মাছ পাওয়া যাবে না!’

আলিফার অক্সফোর্ডে তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক অ্যালেক্স রজার্সের কথা মনে পড়ে যায়। ব্যক্তিগত সাবমেরিন নিয়ে ইচ্ছেমতো সমুদ্রের গভীরে চলে যান এই অধ্যাপক, গবেষণা করেন। কিন্তু আলিফা হকের তো সেসব আকাশকুসুম ভেবে লাভ নেই! তিনি অন্য রাস্তা ধরলেন। জেলেদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করলেন। তাঁদের নিয়ে নানা কাজ করলেন। সমস্যার সমাধানও হলো।

বছর দেড়েক পর একদিন নৌকা নিয়ে সমুদ্রে গেছেন। মাছ দেখার চেষ্টায় আছেন। এমন সময় দূর থেকে মাছধরার একটি ট্রলার তাঁর নৌকার কাছে চলে আসে। জেলেরা তাঁকে নিজেদের ট্রলারে উঠে কাজ করার অনুরোধ করেন।

শুনে তরুণ গবেষক অবাক, ‘আপনারা আমাকে ট্রলারে নেবেন?’

আরও পড়ুন
হাঙর নিয়ে গবেষণা করেছেন আলিফা হক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

জেলেদের ঝটপট উত্তর, ‘কেন নেব না। আপনি তো আমাদেরই লোক!’

আস্তে ধীরে এভাবে উপকূলের জেলেদের আপনজন হয়ে উঠলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলিফা বিনতে হক। গড়ে তুললেন বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অঞ্চলের এক সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার। হয়ে উঠেছেন মেগাফনা  (বড় বড় মাছ, যেমন হাঙর, শাপলাপাতা মাছ ইত্যাদি) বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাছে রয়েছে বিশ্বের ৫০টি দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া ও বাংলাদেশে বিপন্ন হয়ে ওঠা শাপলাপাতা প্রজাতির করাত মাছের (স ফিশ) বিস্তৃত তথ্য। সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়কে কাজে লাগিয়ে বন্য প্রাণী রক্ষার টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য গত বছর উইংস ওয়ার্ল্ড কোয়েস্টের ‘ওমেন অব ডিসকভারি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ পেয়েছেন আলিফা। একই বছর যুক্তরাজ্যের এডিনবরা ইউনিভার্সিটি তাঁকে সে বছরের সাত ‘ওশান লিডারস’–এর একজন নির্বাচন করে। এরও আগে, ২০১৯ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং জিওলজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডন থেকে ফটো আর্ক এজ ফেলোশিপ লাভ করেন আলিফা।

আরও পড়ুন
বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অঞ্চলের এক সমৃদ্ধ তথ্যভান্ডার গড়ে তুলেছেন আলিফা বিনতে হক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বন্য প্রাণীর জন্য ভালোবাসা

বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করতে হলে রক্ষা করতে হবে বন্য প্রাণীদের আবাসস্থল, তাদের খাবার এবং সহজ চলাফেরার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার তাদের ঘিরে যাদের জীবন-জীবিকা, তাদের প্রতিও দিতে হবে নজর। শুধু আইন করে, জেল-জরিমানার ভয় দেখিয়ে তাদের নিবৃত্ত করা কঠিন। তাদের যুক্ত করে, তাদের সঙ্গে জ্ঞানের আদান-প্রদান করেই বরং টেকসই পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। আলিফার এই কাজ বর্তমান বিশ্বে সম্প্রদায়ভিত্তিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার ধারণাকে জোরদার করেছে।

‘আমাদের জেলেরা এই হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ ধরে বিক্রি করেন। দেশে সেভাবে জনপ্রিয় না হলেও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে হাঙর ও শাপলাপাতা মাছ খাবার হিসেবে চালু আছে। এর বিশ্ববাজার প্রায় ২৬০ কোটি ডলারের বেশি। এখন আমি যদি জেলেদের এই কাজ থেকে বিরত থাকতে বলি, তাহলে সেটা কখনো বাস্তবসম্মত হবে না। বরং আমরা যদি তাঁদের বোঝাতে পারি, কোন কোন সময়ে এরা সংখ্যায় বাড়ে, কী করলে এদের সংখ্যা বাড়বে এবং কীভাবে নির্বংশ না করেই জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করা যাবে, তাহলেই বরং বিপন্ন প্রজাতির মাছ বা প্রাণী সংরক্ষণে আমরা সফল হব,’ বলেন আলিফা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুল হক ও শাহিন আক্তার দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় আলিফা। মায়ের বই পড়ার স্বভাব পেয়েছেন আলিফা। ভিকারুননিসা স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। জীবজগতের সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে শুরু করেন আলিফা। ঘুরতে থাকেন নানা জায়গায়। 

‘অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম আমাদের নানা জায়গায় নিয়ে যেতেন। ছোট ছোট প্রজেক্টে কাজ করার সুযোগ দিতেন। আমি টিউশনি করাতাম। টাকা জমিয়ে তৃতীয় বর্ষে প্রথম কক্সবাজার যাওয়ার পর আমার মেরিন বায়োলজি নিয়ে কাজ করার ভিত্তিটা পেয়েছি,’ জানালেন আলিফা।

স্নাতকোত্তর শেষে দ্বিতীয় মাস্টার্সের জন্য যুক্তরাজ্য যান আলিফা। সেখানেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক অ্যালেক্স রজার্সের সঙ্গে পরিচয়। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে মাস্টার্স করে আবার দেশে ফিরে আসেন। কিছুদিন একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত দিনে স্থির করে ফেলেছেন হাঙর ও শাপলাপাতা নিয়ে কাজ করবেন। সেটিই শুরু করেন ২০১৭ সালে। দুই বছর পর হাঙর ও শাপলাপাতার টেকসই সংরক্ষণ বিষয়ে পিএইচডি করার জন্য আবার অক্সফোর্ডে চলে যান। ২০২৩ সালে পিএইচডি করে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বেঙ্গল ইলসামো’ নামে একটি ল্যাব গড়ে তোলেন।

সম্প্রদায়ভিত্তিক সংরক্ষণের পাশাপাশি মেগাফনা নিয়ে কাজ অব্যাহত রেখেছেন আলিফা। পাশাপাশি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্য প্রাণী রক্ষার আহ্বান পৌঁছে দিতে চান। কুয়াকাটার একটি স্কুলে গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞান ক্লাব। এই ক্লাবের সদস্যরা নিয়মিত বিজ্ঞান ও বন্য প্রাণী নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। যুক্ত হয়েছেন ওয়াইল্ডলাইফ অলিম্পিয়াডের সঙ্গে। আলিফা মনে করেন, ‘বন্য প্রাণীদের বাঁচাতে হলে তাদেরকে আমাদের ভালোবাসতে হবে।’

সেই ভালোবাসা দিয়েই বন্য প্রাণী সংরক্ষণে আলিফার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।