বেতনের দেড় হাজার টাকাই ছিল সম্বল

আজ মা দিবসে মাকে নিয়ে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শাকিল আনোয়ার

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

জীবনের যত অর্জন, যা কিছু পাওয়া—সবকিছুর পেছনের কারিগর আমার মা। খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছি। বয়স তখন পাঁচের কাছাকাছি। মা-বাবা দুজনই ছিলেন স্নাতকোত্তর পাস। বাবা মানিকপীর বেংহারী ফাজিল মাদ্রাসার আরবি প্রভাষক হিসেবে চাকরি করতেন। আর আম্মু প্রথমে আরডিআরএসে চাকরি করতেন। পরে মানিকপীর গার্লস হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। বাবা মারা যাওয়ার আগপর্যন্ত পারিবারিকভাবে বেশ সচ্ছল ছিলাম আমরা। মানিকপীর গার্লস স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার বাবা। বেতনের অধিকাংশ টাকাই স্কুলের পেছনে খরচ করতেন। পাশাপাশি জমিজমা যা ছিল, সবকিছু বিক্রি করেন এই স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য। নিজেদের জন্য একটা বাড়ি করার কথাও কখনো ভাবেননি।

বাবা যখন প্রভাষক হিসেবে পদোন্নতি পান, আম্মু তখন স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দেন। যেন বাসায় আমাদের দেখাশোনা করতে পারেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! এর কিছুদিন পরই বাবা হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। তত দিনে আম্মু প্রধান শিক্ষকের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। এদিকে জমিজমা, সঞ্চয় কিছুই নেই। ছিল কেবল দাদার আমলে বানানো একটামাত্র কাঠের ঘর। দাদা-দাদি কেউই বেঁচে ছিলেন না। নানা বেঁচে ছিলেন। কিন্তু দুই মাস পর তিনিও মারা যান।

আম্মু আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তার সাগরে পড়েন। কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। দেড় হাজার টাকা বেতনে ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি নেন। শুরু হয় আমাদের নিয়ে তাঁর সংগ্রাম। সম্বল বলতে ছিল বেতনের সেই দেড় হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আমাদের খাওয়াদাওয়া, আপুর পড়াশোনা, কেনাকাটা সবই চলত। মাকে দেখেছি, কীভাবে কত হিসাব করে সারা মাস পার করতেন। কোনো কোনো মাসে এক-আধ বেলাও মাংস রান্না হতো না। যখন বাজার করতাম, বাজারের সবচেয়ে কম দামি মাছ বা মাংস খুঁজতাম। এভাবে ১২ বছর ব্র্যাক স্কুলে শিক্ষকতা করে, দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে মা আমাদের পড়াশোনা করিয়েছেন। ব্র্যাক স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে স্থানীয় একটি এনজিওতে আরও তিন বছর চাকরি করেন তিনি।

আরও পড়ুন

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ব্র্যাক স্কুলে বিনা মূল্যে পড়ালেখা করেছি। এইচএসসি পর্যন্ত মা পড়াশোনায় সহায়তা করেছেন। আমার কোনো দিন অভিধান প্রয়োজন হয়নি। কোনো শব্দের অর্থ না জানলে মাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতেন।

সৃষ্টিকর্তা আমাকে বাবার স্নেহ, ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ দেননি। তাতে আমার কোনো আক্ষেপ নেই। কেননা তার পুরোটাই মিটিয়ে দিয়েছেন আমার মায়ের মাধ্যমে। এই তো আমার পরম পাওয়া।