বাংলাদেশের আতিয়া এখন ‘কানাডার মুখ’

কালাজ্বরের কার্যকর ওষুধ তৈরির মতো একটা জটিল বিষয় তিন মিনিটে বর্ণনা করে প্রথম স্থান পেয়েছেন আতিয়া বিনতে আমিন
ছবি: সংগৃহীত

প্রতিযোগিতার নাম ‘থ্রি মিনিট থিসিস (থ্রিএমটি) ’। একজন প্রতিযোগীকে তিন মিনিটের মধ্যে তাঁর স্নাতক গবেষণার বিষয়বস্তু বর্ণনা করতে হয়। সেই বর্ণনাও হতে হয় এমন, যেন সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারেন। কালাজ্বরের কার্যকর ওষুধ তৈরির মতো একটা জটিল বিষয় তিন মিনিটে বর্ণনা করে প্রথম স্থান পেয়েছেন আতিয়া বিনতে আমিন। কানাডার মনট্রিয়লে অবস্থিত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবদেহের জীনতত্ত্বের ওপর পিএইচডি করছেন এই বাংলাদেশি শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন

স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘থ্রি মিনিট থিসিস’ নামের এই জনপ্রিয় প্রতিযোগিতা বিশ্বের প্রায় ৮৫টি দেশে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়। এই বছর কানাডায় ৪৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দুই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক ধাপ শেষে প্রথম হন আতিয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় বিজয়ী একজন অংশ নেন আঞ্চলিক পর্বে। এ পর্বে কানাডার পূর্বাঞ্চলের মোট ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রথম স্থান পাওয়া প্রতিযোগীরা অংশ নিয়েছিলেন। আঞ্চলিক পর্বেও আতিয়া প্রথম হয়েছেন। পাশাপাশি দর্শকের ভোটে পান ‘পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড’। কানাডার পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল এবং অন্টারিও থেকে ৯ জন অংশ নেন জাতীয় পর্বে।

২৯ বছর বয়সী আতিয়ার সঙ্গে কথা হলো গত ২০ নভেম্বর, হোয়াটসঅ্যাপে। তিনি ময়মনসিংহের মেয়ে। বাবা মো. আমিনুল ইসলাম ময়মনসিংহের বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবসর নিয়েছেন। মা ফাতেমা আক্তার একই বিদ্যালয় থেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে অবসর নেন। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে আতিয়া বড়। আতিয়া ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হাই স্কুল থেকে এসএসসি ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। মাস্টার্স করতে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। এর আগে ২০১৬ সালে বিয়ে করেন। ২০১৯ সালে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন। স্বামী হক মুহাম্মদ ইশফাক একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করছেন।

আতিয়া কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন
ছবি: সংগৃহীত

শুনিয়েছিলেন কালাজ্বর আক্রান্ত এশার কথা

মন্ট্রিয়ালে হোটেল শেরাটনে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় প্রতিযোগিতা। আতিয়া জানান, অনলাইনে প্রতিযোগিতাটি সরাসরি দেখছিলেন তাঁর স্বজন, বন্ধু, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনুজীব বিজ্ঞান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। সবকিছু মিলিয়ে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের চাপও অনুভব করছিলেন তিনি।

প্রতিযোগীরা লিঙ্গ বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট, হৃদরোগ বা ক্যান্সারের মতো জটিল রোগ, বয়ষ্ক জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন, ইত্যাদি বিষয়ে তিন মিনিটে তাঁদের থিসিস উপস্থাপন করেন। আতিয়ার ডাক পড়ে সবার প্রথমে। তিনি বলেন কালাজ্বরের কথা।

কালাজ্বরের জন্য কীভাবে কার্যকর ওষুধ তৈরি করা যায়, তা নিয়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে গবেষণা করছেন আতিয়া। কারণ কালাজ্বরের যেসব ওষুধ আছে, তার অর্ধেকেরও বেশি ক্ষেত্রে পরজীবীটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। কানাডার মানুষের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই রোগটি মাত্র তিন মিনিটে উপস্থাপন, সেই সঙ্গে গবেষণার ফলাফল ও গুরুত্ব তুলে ধরা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সবাইকে সহজভাবে বোঝাতে আতিয়া তুলে আনেন ১২ বছরের এক কিশোরীর গল্প। তার নাম এশা। কালাজ্বর নিয়ে ২০২১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষনায় তিনি এশার ঘটনাটি পেয়েছিলেন।

সামনে থ্রি মিনিট থিসিসের আন্তর্জাতিক পর্বে লড়বেন তিনি
ছবি: সংগৃহীত

আতিয়া বলেন, ‘এশার দেহে কালাজ্বরের ওষুধ কাজ করছিল না। নতুন কার্যকরি ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা না করালে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই রোগে মৃত্যু অবধারিত। এশার গল্প দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আমাদের গবেষণার মাধ্যমে একদিন কার্যকর ওষুধ তৈরি হবে, এমন প্রত্যাশার কথা বলেছি দর্শকদের। এর জন্য দরকার উন্নত দেশগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা। এশা বেঁচে আছে কি না জানি না। চাই না আর কেউ এশার মতো কালাজ্বরের জটিলতায় পড়ুক।’

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ক্যানসারবিজ্ঞানী সুবর্ণা আফরিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উত্তর আমেরিকা চ্যাপ্টারের সহসভাপতি। আতিয়া ওই চ্যাপ্টারের গণমাধ্যম ও যোগাযোগ শাখার কো চেয়ার। সুবর্ণা আফরিনের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করলে বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় আতিয়ার বক্তব্য আমি শুনেছি। এ ধরণের একটি বিষয় সহজভাবে বোঝানো খুবই চ্যালেঞ্জের। বিশ্ব বিজ্ঞানের মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম যুক্ত করার ক্ষেত্রে আতিয়া আরও অনেক বাংলাদেশির জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।’

ম্যাকগিলে আতিয়া ও বাংলাদেশের নাম

বিজয়ী হিসেবে নাম ঘোষণার পর অন্য প্রতিযোগীরা অভিনন্দন জানাতে থাকেন আতিয়াকে। এর মধ্যে একজন বলে ওঠেন, ‘আতিয়া, ইউ আর দ্য ফেস অব কানাডা নাউ’ (তুমি এখন কানাডার মুখ)। এই এক মন্তব্য আতিয়াকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল তাঁর লড়াইয়ে গল্পে। চোখের সামনে ভেসে উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যুক্তরাষ্ট ও কানাডা—গত দশ বছরের শিক্ষাজীবনের কঠিন সব সময়। কী কষ্টই না করতে হয়েছে! যুক্তরাষ্ট্রে মাস্টার্স করার শুরুর দিকে চামড়ার রং, ভাষাগত পার্থক্যের কারণে কম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। আতিয়ার ভাষায়, ‘জীবন হয়তো এভাবেই দেয় পরিশ্রমের প্রতিদান। শুধু ধৈর্য আর মনোবল শক্ত রেখে এগিয়ে যেতে হয় সামনে।’

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে থ্রি মিনিট থিসিসের ‘নর্থ আমেরিকান ফাইনাল’ নামে আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতা। সেখানে কানাডার প্রতিনিধিত্ব করবেন আতিয়া। প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ধাপে পুরস্কার হিসেবে আতিয়া পেয়েছেন দুই হাজার কানাডিয়ান ডলার বা দেড় লাখ টাকার বেশি। আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় আতিয়াকে আরও প্রায় তিন লাখ টাকা দিয়েছে।

আতিয়ার সুপারভাইজার, ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের সহকারী অধ্যাপক ডেভিড ল্যাংলাইস এক ইমেইলের জবাবে জানান, থ্রিএমটি প্রতিযোগিতায় আতিয়ার বিজয়ে তিনি গর্বিত। আতিয়াসহ তাঁর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও নতুন ধরণের গবেষণা প্রকল্প নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি এ বিষয়ে বিভিন্ন ধরণের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাবে, এমনটাই তাঁর আশা।

আতিয়া জানালেন, এই প্রতিযোগিতার সুবাদে ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেকেই তাঁকে চেনেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যখন যান, তাঁকে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তখন তিনি নিজেকে বাংলাদেশের মেয়ে বলে পরিচয় দেন। অনেকে তখন বাংলাদেশ সম্পর্কে, তাঁর গবেষণা সম্পর্কে জানতে চায়।

আতিয়ার ভাষায়, ‘ভাবতে ভালো লাগে যে, এই সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমার দেশ সম্পর্কে বিদেশের মাটিতে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পেরেছি। দেশ থেকে যোজন যোজন দূরে এটুকু করতে পারার মধ্যে যে তৃপ্তি, তা আসলেই অমূল্য।’