ঘরের আসবাব কোথায় কীভাবে রাখলে ভূমিকম্পে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে

ভূমিকম্পে ভবন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও টালমাটাল আসবাব কিংবা ভুলভাবে বসানো আসবাব মানুষের ওপর পড়ে আহত হওয়ার প্রধান কারণ হয়ে ওঠে। ১৯৯৫ সালে জাপানের হানশিন ভূমিকম্পে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছিলেন শুধু আসবাবপত্র ভেঙে তাঁদের ওপরে পড়ায়। তাই জেনে রাখুন ঘরের কোথায়, কীভাবে আসবাব রাখবেন।

দেয়ালের স্টোরেজ যথাযথভাবে আটকানো আছে কিনা, যাচাই করে নিন আরেকবারছবি: প্রথম আলো

মানুষ একটি স্থিতিশীল ও সুরক্ষিত জীবনযাপনের স্বপ্নে বাড়ি নির্মাণ করে। ভালো উপকরণ, সুন্দর নকশা এবং আধুনিক সুবিধাযুক্ত বাসস্থানকে আমরা নিরাপত্তার প্রতীক মনে করি। সুরক্ষা বলতে আমরা প্রথমেই ভাবি ভবনের স্থায়িত্ব নিয়ে। স্ট্রাকচারাল স্ট্যাবিলিটি, ইঞ্জিনিয়ারিং কোড, নির্মাণ উপকরণের মান ইত্যাদি।

শিশুদের ঘরে উঁচু ও এমন খোলা তাকের ওপর ভারী কিছু না রাখাই ভালো
ছবি: প্রথম আলো

ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকায় কেবল ভবনের কাঠামোগত স্থিতিশীলতা মানুষের জীবন রক্ষায় যথেষ্ট নয়। একটি ভবন যদি দাঁড়িয়ে থাকে, তার মানে এই নয় যে ঘরের ভেতরের সবকিছু নিরাপদ। বিশেষত আসবাব এবং অন্দরের উপকরণ ভূমিকম্পের সময় মানুষের জন্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

আসবাব প্রাথমিকভাবে নান্দনিকতা, আরাম এবং ব্যবহারিক সুবিধার জন্য নির্বাচিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতা হিসেবে আমরা বিবেচনা করি ব্র্যান্ড, ফিনিশিং, কাঠের গুণমান এবং ডিজাইনের স্বতন্ত্রতা।

কিন্তু ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হয় সেই সব আসবাবের মাধ্যমে, যা হঠাৎ পড়ে গিয়ে বা ভেঙে গিয়ে মারাত্মক আঘাত করতে পারে। বুকশেলফ, আলমারি, শোকেস, টেলিভিশন ইউনিট, কাচের ডাইনিং টেবিল, ঝোলানো নানা কিছু এবং দেয়ালের আয়না ভূমিকম্পের সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

আরও পড়ুন

যেসব আসবাবে ঝুঁকি বেশি

ঝুঁকির মূল কারণের মধ্যে অন্যতম হলো নকশাগত এবং পরিকল্পনার অভাব। দেয়ালে যথাযথভাবে না আটকানো আলমারি, বুকশেলফ, স্ট্যান্ডে রাখা বড় আকারের টেলিভিশন, খোলা তাকে রাখা ভারী শোপিস, অতিরিক্ত ভারী বা ভারসাম্যহীন আসবাব, শিশুদের ঘরে উঁচু ও ঢিলেঢালা স্টোরেজ, কাচের টেবিল বা শোকেসে নন-টেম্পার্ড গ্লাসের ব্যবহার—এসবই ভূমিকম্পের সময় ঝুঁকি বাড়ায়।

কাচের আয়না এভাবে রাখলে ঝুঁকি বাড়তে পারে
ছবি: প্রথম আলো

ভূমিকম্পনপ্রবণ এলাকায় আসবাবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নকশায় কিছু মৌলিক নীতিমালা থাকা জরুরি। আলমারি, বুকশেলফ এবং স্টোরেজ ইউনিটকে দেয়ালে স্ক্রু অ্যাংকার বা স্টিল ব্র্যাকেটের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে লাগানো, বড় টেলিভিশন ওয়াল-মাউন্টে রাখার মাধ্যমে স্থির রাখা এবং খোলা তাকে ভারী জিনিস না রেখে নিচে রাখা। কাচের টেবিল বা শোকেসে টেম্পার্ড বা ল্যামিনেটেড সেফটি গ্লাস ব্যবহার করা প্রয়োজন।

শিশুদের ঘরে উঁচু বা ঢিলেঢালা আসবাব সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলা উচিত। এ ধরনের ব্যবস্থা শুধু আবাসিক ভবনের জন্য নয়, স্কুল, হাসপাতাল, হোটেল এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলোর জন্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন

কোন ধরনের আসবাব নিরাপদ

ঘরের প্রতিটি আসবাবই যে বিপজ্জনক, তা নয়; বরং সঠিক ও পরিকল্পিত কিছু আসবাব এ ধরনের বিপদে রক্ষাও করবে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত নিরাপত্তাবিধি ‘ড্রপ–কাভার–হোল্ড–অন’ অনুযায়ী ভূমিকম্পের সময় দৌড় না দিয়ে আশপাশের কোনো শক্ত টেবিল বা স্থায়ী কাঠামোর নিচে আশ্রয় নেওয়া উচিত।

দৌড় দিলে আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। বরং দ্রুত নিচে বসে, মাথা ঢেকে শক্ত কাঠামোর নিচে আশ্রয় নিয়ে টেবিলের পা বা আসবাবের বেজ ধরে থাকা নিরাপদ।

মাথা ঢেকে শক্ত কাঠামোর নিচে আশ্রয় নিন
ছবি: পেক্সেলস

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সব আসবাবের নিচে কি আশ্রয় নেওয়া যায়? উত্তর হলো, ‘না’। আশ্রয় নেওয়ার জন্য আসবাবের শক্তি, উচ্চতা, উপাদান সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ।

সলিড কাঠের বা মার্বেলের ডাইনিং টেবিল, ভারী পড়ার টেবিল বা বিমের নিচে দেয়ালে স্থায়ীভাবে লাগানো বিল্ট-ইন আসবাবের নিচে আশ্রয় নেওয়া তুলনামূলক নিরাপদ।

কারণ, এ ধরনের কাঠামো ধাক্কায় ভেঙে পড়লেও ‘এয়ার-পকেট’ তৈরি করে, যা মানুষের মাথা, ঘাড় ও বুককে সরাসরি আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে।

বিছানার কাছাকাছি শেলফ, আয়না বা ভারী ছবির ফ্রেম ঝুলিয়ে রাখবেন না
ছবি: প্রথম আলো

গবেষণায় বলা হয়েছে, শক্ত বা স্থায়ীভাবে আটকানো আসবাবের পাশে অনেক সময় নিরাপদ জায়গা বা জোন তৈরি হয়, যাকে ‘ট্রায়াঙ্গল অব লাইফ’ বলা হয়, যেখানে ভারী বস্তু ধসে পড়লেও একটি ত্রিকোণ ফাঁকা জায়গা আমাদের রক্ষা করতে পারে। কিন্তু এই ধারণা সব ঘরে সমানভাবে কার্যকর নয়।

ট্রায়াঙ্গল অব লাইফ নির্ভর করে আসবাবের শক্তি ও স্থিরতার ওপর। পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আছে। সেটি হলো, আসবাবটি নিজের ওজনেই ভেঙে পড়বে কি না? তাই এই কৌশল ব্যবহার করার আগে ঘরের আসবাব কি আসলেই সেই আশ্রয় দিতে সক্ষম, তা জানা জরুরি।

আরও পড়ুন

কিছু বিষয় মনে রাখুন

সাধারণত রাতের দিকে ভূমিকম্পের হার বেশি থাকে, যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে। তখন ঘরের আলো নিভে যায়, মানুষের সাড়া দিতে সময় লাগে। বিছানার চারপাশে রাখা আসবাব উল্টে পড়লে পালানোর সুযোগ কমে যায়। তাই বিছানার কাছাকাছি শেলফ, আয়না বা ভারী ছবির ফ্রেম ঝুলিয়ে রাখবেন না।

ভূমিকম্পে প্রথম আঘাত হানতে পারে ভাঙা বস্তু বা দেয়াল থেকে ঝুলন্ত জিনিস। এ জন্য গবেষণা সুপারিশ করে প্রত্যেক ঘরে স্থায়ী জরুরি আলো এবং বহনযোগ্য লাইট থাকা উচিত, যাতে ভূমিকম্পের সময় দ্রুত বের হওয়ার পথ চোখে পড়ে।

স্থাপত্য এবং ইন্টেরিয়র ডিজাইন কেবল নান্দনিকতার শিল্প নয়; এটি মানবিক নিরাপত্তার দায়িত্বও বহন করে। তাই আসবাব নকশা, নির্বাচন, স্থাপন এবং উপকরণ ব্যবহারে প্রযুক্তিগত গাইডলাইন থাকা আবশ্যক।

শেষ কথা

একটি ঘর কেবল আমাদের থাকার জায়গা নয়, তা আমাদের জীবনের রক্ষাকবচও হতে পারে, যদি আমরা সেটিকে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করি।

সেই পরিকল্পনা শুধু সুন্দর ফিনিশিং বা দামি আসবাব কেনায় নয়; বরং আসবাব স্থাপন, কাঠামোগত নিরাপত্তা এবং বাস্তবিক পরিস্থিতিতে কোন আসবাব ব্যবহার করলে তা আমাদের জীবন রক্ষা করবে এটি বোঝা জরুরি।

ভূমিকম্প ভীতিকর সত্য, কিন্তু সেই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত ঘরই হতে পারে জীবন রক্ষাকারী শক্ত ঢাল।

লেখক: স্থপতি

আরও পড়ুন