‘আমার পেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে সততার অভাব আমাকে বড় লজ্জা দেয়’

ঢাকার ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সপ্তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হলো গত ২৫ ফেব্রুয়ারি। সমাবর্তন বক্তা ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। এখানে থাকল তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতার নির্বাচিত অংশ৷

ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আইনুন নিশাত
ছবি: সংগৃহীত

আজকে যাঁরা ডিগ্রি পাবেন, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অধ্যায় শেষ করবেন, তাঁদের আন্তরিক অভিনন্দন। ‘একটি অধ্যায়’ শব্দযুগল ব্যবহার করলাম এই কারণে যে আমি আশা করব, আজ যাঁরা স্নাতক ডিগ্রি নেবেন, তাঁরা স্নাতকোত্তর করবেন, আরও পড়াশোনা করবেন। যাঁরা স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন, তাঁরা পিএইচডি করবেন কিংবা কোনো একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করবেন। কথাটা এ জন্য বলছি যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ বা বিশেষজ্ঞ হওয়া বর্তমান সময়ের একটা দাবি৷ প্রতিযোগিতামূলক পৃথিবীতে ভালো করতে হলে বিশেষজ্ঞতা বা বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন।

এখন প্রশ্ন হলো যে বিষয়ে স্নাতক হলাম, সে বিষয়টা ধরেই কি বসে থাকব? আমার উত্তর, ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’। বিষয়টি যদি ভালো লাগে, তাহলে তাকে কেন্দ্র করেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। যদি দেখা যায়, অন্য কোনো বিষয়ে আগ্রহ জন্মেছে কিংবা পারদর্শিতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে, সে কারণে ‘না’ শব্দটি ব্যবহার করেছি৷ দুটি কারণে আমি আমার অধ্যয়নের বিষয় বদলাতে পারি। প্রথমত, আমি নতুন বিষয়ে আরও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আশা করছি অথবা নতুন বিষয়টি আমার মনে তৃপ্তির জোগান দেবে৷ উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, আজকে যিনি ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে ডিগ্রি অর্জন করলেন, তিনি অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান কিংবা কম্পিউটার সফটওয়্যারে আগ্রহী হতে পারেন। ইতিহাস বিষয়েও পড়াশোনা করতে পারেন। মূল কথা হচ্ছে, উপভোগ করতে হবে৷ উপভোগ করলেই আসবে সফলতা৷

মনে রাখা প্রয়োজন, জ্ঞান অর্জনের কোনো সীমা নেই। কাজেই, আমার ব্যক্তিগত উপদেশ হলো, আজ যে ডিগ্রি নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, সে বিষয়ে ফ্লেক্সিবিলিটি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগোতে হবে। প্রয়োজনবোধে কর্মক্ষেত্রকে ওই বিশেষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রসারিত করুন। আমি নিজে তাই করেছি। আমি পুরকৌশল প্রকৌশলী। পিএইচডিও করেছি নদীবিজ্ঞানে৷ কিন্তু পরবর্তীতে নতুন নতুন অনেক বিষয়ে পড়াশোনা করেছি, কাজ করেছি এবং উপভোগ করেছি। এটাই সবচেয়ে বড় কথা৷

প্রিয় স্নাতকবৃন্দ, ডিগ্রি পাওয়ার পরে পড়াশোনার পাট–চুকিয়ে দেবেন, এটা যেন না হয়৷ জ্ঞানবিজ্ঞানের মহাসড়কে আপনাদের পদচারণ অব্যাহত থাকবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেছি ১৯৬৯ সালে৷ সেই সময়ের তুলনায় আপনাদের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি৷ (আমাদের সময়) লাইব্রেরিতে গিয়ে ধুলা ঘেঁটে বইপত্র কিংবা জার্নাল বের করতে হতো, পড়াশোনা করতে হতো। আপনারা ল্যাপটপ কিংবা পিসিতে (পার্সোনাল কম্পিউটার) একটা বোতাম টিপেই গুগলের মাধ্যমে বিশ্বের জ্ঞানভান্ডার আপনার কাছে নিয়ে আসতে পারেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনাদের সবার পকেটে স্মার্টফোন আছে৷ আমার পকেটেও একটা আছে৷ কেবল কথাবার্তা বা বার্তা আদান-প্রদানের জন্য স্মার্টফোনটির ব্যবহার সীমিত রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে। এটির অপরিসীম ক্ষমতা৷ বিশ্বের তথ্য ও জ্ঞানভান্ডারকে সহজেই আপনার হাতের মুঠোয় এনে দিতে পারে। এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করুন।

আরও পড়ুন

যে কথাগুলো মনে রাখবেন

প্রিয় স্নাতকবৃন্দ, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালীন যে কর্মকাণ্ড হয়, সেটাকে সঠিক রাস্তায় নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু সিলেবাসের ভিত্তিতে পড়াশোনা করলে চলবে না৷ এর বাইরেও অনেক বিষয়ে নিজেদের দখল আনতে হবে। আমি মনে করি, সামাজিক বিজ্ঞানের ব্যবহারিক বহু বিষয় আমাদের জানা দরকার। তাতে করে সমাজটা আরও ভালো হবে৷ আপনিও একজন ভালো মানুষ হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে শুধু পেশা জগতে প্রবেশের জন্য নয়, জীবনের জন্যও তৈরি করবে৷ সৎ পথে চলতে শেখাবে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে শেখাবে, গুরুজনের সেবা করতে শেখাবে এবং দেশকে সেবা করতে শেখাবে৷

তথাকথিত আধুনিকায়নের নামে সমাজ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। এটা আমার একদম পছন্দ হয় না৷ আমাদের ধর্মে পরিষ্কার বলা আছে যে বৃদ্ধ বয়সে তোমার পিতামাতার প্রতি তোমার ব্যবহার এমন হবে, যাতে কষ্ট পেয়ে তাঁরা ‘উহ’ শব্দটা পর্যন্ত না করেন৷ আমার বিশ্বাস, আজকে যে চারটি ধর্মবাণীর কিছু অংশ পাঠ করে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হলো, সব ধর্মে একই কথা বলা আছে৷ মূলমন্ত্র কিন্তু একই৷ অথচ ছেলেমেয়েরা যেন বৃদ্ধ পিতামাতার দেখভাল করে, তার জন্য আমাদের দেশে আইন করতে হচ্ছে। কতটা দুঃখজনক ব্যাপার। প্রায়ই আমি খবরের কাগজে পড়ি, বৃদ্ধ পিতামাতাকে গোয়ালঘরে ঠাঁই দেওয়া হয়েছে; কী লজ্জার ব্যাপার! এ ধরনের আচার-আচরণ কোনো সমাজের জন্যই কাম্য নয়। সংক্ষেপে এটাই বলতে চাই, শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া। এ দায়িত্ব পিতামাতার প্রতি, পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতি, প্রতিবেশীদের প্রতি; তদুপরি, দায়িত্ব হবে জাতির জন্য। আমার এই কথাগুলো সম্পর্কে সবাই অবহিত, সবাই জানেন। কিন্তু বর্তমান সময়ের অস্থিরতা দেখে কথাগুলো মনে করিয়ে দিলাম।

প্রিয় স্নাতকবৃন্দ, নিজের জীবন থেকে আপনাদের বলছি। আমি আমার জীবনকে চারটি কোয়াড্রান্ট বা টুকরায় ভাগ করতে চাই। প্রথম ভাগ বোধ করি শূন্য থেকে ১৫–১৬ বছর বয়স পর্যন্ত। এটা হচ্ছে ভিত্তি তৈরির বয়স৷ এখানে আপনাদের অভিভাবকেরা যেভাবে পথ দেখাবেন, সেভাবে আপনাকে চলতে হবে। ১৫–১৬ থেকে ৩০–৩২ অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আপনি জীবন, পেশা, কর্মক্ষেত্র—সবকিছুর জন্য নিজেকে তৈরি করবেন। শিক্ষায় ডিগ্রি অর্জন করবেন। ৩০ বছর বয়সে পিএইচডি করতে যাওয়াতে কোনো লজ্জা নেই, অসুবিধা নেই। যখন সুযোগ পাবেন, তখনই করবেন। তৃতীয় ভাগ হচ্ছে, ৩০–৩২ থেকে ৪৫–৪৬। এই ব্লকে আপনি কর্মক্ষেত্রে আছেন। আপনার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। শিখবেন, জ্ঞানের পরিধি বাড়াবেন, অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়াবেন। চতুর্থ টুকরো হচ্ছে ৪৫–৪৬ থেকে ৬০–৬৫ পর্যন্ত। আমি বছর নির্দিষ্ট করে দিচ্ছি না, কিন্তু এই সময়ে আপনি অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার ভিত্তিতে ধীরস্থিরভাবে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। এরপর যত দিন বাঁচবেন, এটা আপনার শেষ জীবন। উপভোগ করার ব্যাপার। আগের দুটো ভাগে যদি ঠিকমতো কাজ করে থাকেন, তাহলে অবসরজীবন অবশ্যই সুখময় হবে। কিন্তু অবসরজীবন বাড়িতে বসে থাকবেন, তা হবে না৷ তখনো আপনি জ্ঞানের জগতে বিচরণ করতে পারেন। দক্ষতা বাড়াতে পারেন।

আধুনিক সমাজে নৈতিক কর্মকাণ্ডের বড় অভাব৷ আমি পেশায় পুরকৌশল প্রকৌশলী। আমার পেশায় নিয়োজিতদের মধ্যে সততার অভাব আমাকে বড় লজ্জা দেয়, পীড়া দেয়। লজ্জার সঙ্গে আজকে বলতে হচ্ছে, দেশের প্রতিটি পেশায় সততা, দেশপ্রেম ও নৈতিকতার বড়ই অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা নিয়ে কিছু করছে বলে আমার জানা নেই। আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত, সেখানে নৈতিকতা নিয়ে একটা কোর্স আছে। কিন্তু সেটাই কি যথেষ্ট? ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই বিশ্ববিদ্যালয় যদি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভূমিকা পালন করে, তাহলে সমগ্র জাতি এ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। তবে আমি জেনেছি, এখানকার শিক্ষকবৃন্দ উঁচুমানের দক্ষতা ও যোগ্যতার মাধ্যমে আপনাদের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে কাজ করছেন৷ আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সব ছাত্রছাত্রীর জন্য একটি উজ্জ্বল, সফল ও সার্থক জীবন কামনা করে আমার কথা শেষ করছি।