যেভাবে তৈরি হলো সংসদ ভবন
স্থাপত্যশৈলী ও নান্দনিকতার দিক দিয়ে যে কয়টি স্থাপনা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে জায়গা করে দিয়েছে, জাতীয় সংসদ ভবন তার একটি। মার্কিন স্থপতি ও নগরবিদ লুই ইসাডোর কানের নকশা করা জাতীয় সংসদ ভবন শুধু ঢাকার সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়নি; বরং একে স্থান দিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। ভবনটি গড়ে ওঠার গল্প শোনাচ্ছেন স্থাপত্যের ছাত্র মৃণাল সাহা
সামরিক শাসন জারি করে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখলের পর পাকিস্তানের রাজধানী করাচি থেকে ইসলামাবাদে স্থানান্তর করেন আইয়ুব খান। ওই সময় পরিকল্পনা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে দ্বিতীয় রাজধানী গড়ে তোলা হবে। দ্বিতীয় রাজধানীর জায়গা নির্ধারিত হয় বর্তমান ঢাকার শেরেবাংলা নগর। জায়গাটার নতুন নাম করা হয় আইয়ুব নগর। এত বড় শহর তৈরি করা তো আর চাট্টিখানি কথা না। তৎকালীন পাকিস্তানের সেরা স্থপতিদের কাছ থেকে চাওয়া হয় স্থপতিদের নাম। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম তিনজন স্থপতির নাম প্রস্তাব করেন—ল্য করব্যুজিয়ে, আলভার আইতো ও লুই আই কান। ব্যস্ততা ও বয়সের কারণে প্রস্তাব থেকে বাদ পড়ে করব্যুজিয়ে ও আইতোর নাম। আর প্রস্তাবটি লুফে নেন লুই আই কান।
কারণ কয়েক বছর আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরের উন্নয়নের জন্য একটি পরিকল্পনা জমা দিয়েছিলেন লুই আই কান। কিন্তু সেই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি। তখন থেকেই তাঁর মাথায় নতুন একটা শহর তৈরির পরিকল্পনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে শেরেবাংলা নগর তৈরির প্রস্তাব তাঁকে আকৃষ্ট করে। ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাব তিনি ফেলতে পারেননি। নতুন শহরের জন্য বরাদ্দ ছিল ৮৪০ একর জমি, যার বেশির ভাগই ছিল নিচু ধানি জমি। তবে তাৎক্ষণিকভাবে কাজ শুরুর জন্য তাঁকে দেওয়া হয় ২০০ একর জমি।
কাজ শুরুর আগে জায়গাটাকে তো কাছ থেকে দেখতে হবে। মৌখিক চুক্তি শেষে ১৯৬২ সালে ঢাকা আসেন লুই আই কান। প্রকৃতি ও আলো ছায়া নিয়ে খেলা করা কানের চোখে ধরা পড়ে অপূর্ব এক বাংলাদেশ। পাল যুগের পাহাড়পুর থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমলের আহসান মঞ্জিল—এই অঞ্চলে লাল ইট বেশ সমাদৃত। ঢাকার লালবাগ দূর্গ, লাল ইট, নদী ও সবুজকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা শুরু করেন কান। একই সঙ্গে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, সুপ্রিম কোর্ট, জনপ্রতিনিধিদের থাকার জায়গা, সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বাসস্থান, প্রেসিডেন্ট প্যালেস, স্টেডিয়াম, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি শহর তৈরির পরিকল্পনা ছিল তৎকালীন কর্তৃপক্ষের। সেসব মাথায় রেখেই প্রথম মাস্টারপ্ল্যান জমা দিয়েছিলেন লুই কান।
কানের নকশায় স্বপ্নের শহর
পুরো পরিকল্পনার ব্যাপ্তি ও কাজের পরিমাণ দেখে বেশ আশাবাদী ছিলেন লুই কান। এতটাই উৎসাহী ছিলেন যে কাজ করতে করতে নিজের বিছানা থেকে পর্যন্ত পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। লুই কান নিজেই লিখে গেছেন সেই কথা, ‘তৃতীয় দিন রাতে প্ল্যানিং করতে করতে বিছানা থেকে পড়ে যাই। উপলব্ধি করতে পারছিলাম, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিনিধিত্ব করতে এ জায়গায় আসবে মানুষ। সেই প্রতিফলন এ স্থাপনার মধ্যে আসা উচিত।’
প্রায় এক বছর পর ১৯৬৩ সালের ১২ মার্চ প্রথম মাস্টারপ্ল্যান জমা দেন কান। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও আমলাদের সামনে মডেলসহ উপস্থাপন করা হয় মাস্টারপ্ল্যান। কানের উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত হয় চুক্তি সাক্ষরের। পুরো বাজেটের ৭ শতাংশ স্থপতি লুই আই কানের জন্য বরাদ্দ ছিল। যদিও প্রথম মাস্টারপ্ল্যানের কোনো কিছুই পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয়নি। বেশ কয়েকবার পরিবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে চূড়ান্ত রূপ পায় বর্তমান চেহারা। যে পরিকল্পনায় শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, লেক, হাসপাতাল এবং জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বাসস্থান। জাতীয় সংসদ ভবনকে কেন্দ্র করে যে শহর গড়ে ওঠার পরিকল্পনা ছিল, লুই আই কানের সেই শহর স্বপ্নেই থেকে যায়, বাস্তবে আর রূপ পায়নি।
যা আছে
পুরো শহরের প্ল্যান তৈরিতে সময় নিলেও সংসদ ভবনের মূল প্ল্যান লুই কান জমা দেন ১৯৬৪ সালে। সে অনুযায়ী শুরু হয় কাজ। পুরো প্ল্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মূল সংসদ ভবন, যেখানে বসে সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন করবেন। সংসদে মোট নয়টি ভিন্ন ভিন্ন ব্লক রয়েছে, যার অষ্টভুজাকৃতির ব্লকটি পুরো ভবনের মধ্যমণি। মূল হলরুমকে কেন্দ্র করে এর আট পাশে তৈরি করা হয়েছে আটটি আলাদা ব্লক। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে রয়েছে একই রকম চারটি অফিস। উত্তর দিকে সিঁড়িঘর, পশ্চিম দিকে মন্ত্রী ও আমলাদের চেম্বার। দক্ষিণ দিকে রয়েছে নামাজের ঘর, যা মূল ভবন থেকে সামান্য পশ্চিমমুখী। বিশাল নামাজ ঘরের চার কোণায় চারটি ফাঁপা কলাম। ওপরে আলো আর বাতাস আসার ব্যবস্থা। নামাজ ঘরের নিচেই দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথ, যেখান দিয়ে সবাই প্রবেশ করবেন। মুসলিমপ্রধান দেশে সংসদ সদস্যদের প্রবেশপথ নামাজ ঘরের নিচ দিয়ে তৈরির পেছনে লুই কানের ভাবনা ছিল একটু অন্য রকম। ‘নামাজ ঘরের নিচ দিয়ে আসতে গিয়ে সংসদ সদস্যদের মনে পবিত্র অনুভূতি কাজ করবে।’ নামাজ ঘর থেকে বেরিয়ে সংসদ ভবনের সম্পূর্ণ লাল ইটের তৈরি দক্ষিণ প্লাজা, যেখানে ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ প্লাজার মতো উত্তর প্লাজা দিয়ে বের হলেও চোখে পড়ে প্রেসিডেন্টস প্লাজা। এটিতে অবশ্য মার্বেল পাথরের প্রাধান্য বেশি।
সূর্যকে ভাবনায় রেখে
বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে তৈরি ভবনটির মধ্যে কালজয়ী একটি ভাব আনার চেষ্টা করেছেন লুই আই কান। যেমন করে নির্মাণশৈলীর কল্যাণে রোমান সভ্যতার ভবনগুলো বহু শতাব্দী পরও কালজয়ী হয়ে টিকে রয়েছে।
বাথস অব কারাকালা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শেরেবাংলা নগরের নকশা করেছিলেন লুই আই কান। আর রোমান প্যানথিয়ন থেকে পেয়েছিলেন সংসদের ওপর থেকে আলো আসার অনুপ্রেরণা। লুই আই কানের নকশার অন্যতম বড় অনুষঙ্গ সূর্য। তাঁর মতে, ‘সূর্য নিজেও জানে না সে কত সুন্দর যতক্ষণ না সে একটি ভবনে গায়ে পড়ে।’ সংসদ ভবনকে নিয়েও তিনি করেছেন অদ্ভুত আলো ছায়ার খেলা।
পুরো ভবনের দেয়ালজুড়ে রয়েছে জ্যামিতিক নকশা। বাইরের দেয়াল কেটে খোলা ত্রিভুজ ও বৃত্তাকার নকশা করা হয়েছে। উত্তর দিকে সামনের দেয়াল চিলতে করে ওপর-নিচে কাটা। ফলে দূর থেকে প্রবেশপথ সহজেই বোঝা সম্ভব।
এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ দিকের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার সময় দেয়ালের কাটা অংশ দিয়ে বাইরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা সম্ভব। পুরো ভবনে ব্যবহার করা হয়েছে বেশ কিছু ফাঁপা কলাম, যেখান থেকে বাইরে তাকালে চোখে পড়ে লেক ও আবাসিক এলাকা।
পূর্ব দিকের ফাঁপা কলামে তৈরি করা হয়েছে লাউঞ্জ ও খাওয়াদাওয়ার স্থান। এ ছাড়া রয়েছে ছোট ছোট আকারে কিছু কর্মকর্তার অফিস। অফিসগুলো এমন করে নকশা করা যে দিনের বেলা কাজ করতে আলাদা করে কোনো আলোর প্রয়োজন হয় না, সূর্যের আলোই যথেষ্ট। সংসদ ভবনের প্রধান আকর্ষণ এর মূল হলরুম।
বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো বিশ্বেই এত বড় অ্যাসেম্বলি হল খুব কম আছে। অষ্টভুজাকৃতির হলরুমে সংসদ সদস্যদের বসার স্থান তুলনামূলক কিছুটা নিচু। পশ্চিম পাশে স্পিকারের বসার জায়গা, আর তাঁকে কেন্দ্র করে ৩৫০ সংসদ সদস্যের বসার জায়গা। পুরো হলরুমটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে আলাদা করে নতুন আসন যুক্ত করার সুযোগ নেই বললেই চলে।
ফলে ভবিষ্যতে সংসদ সদস্যদের সংখ্যা বাড়লে তাঁদের স্থান দেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ৭০ ফুট লম্বা হলরুমের ওপরে রয়েছে ছাতার মতো পাতলা কংক্রিটের পাতলা শেলের আচ্ছাদন। এ আচ্ছাদনের ওপরে ছাদ থেকে আলো আনার ব্যবস্থা।
প্রতিফলিত আলো যাতে ছাতার পাশ দিয়ে দেয়ালের গা বেয়ে নেমে আসে তার জন্য এত আয়োজন। প্রথমে স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরির কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত খরচ বাঁচাতে পাতলা কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা হয় রিফ্লেকটরটি।
লুই আই কান পুরো সংসদ ভবনকে ঢেকে দিয়েছেন স্ক্রিন ওয়াল দিয়ে। বাইরের দেয়ালে নকশা করেছেন জ্যামিতিক আকার কেটে। এতে বাইরের রোদ, বৃষ্টি, ঝড় যেমন সরাসরি ভবনে প্রবেশ করতে পারে না, তেমনই সহজে উপভোগ করা বাইরের বাতাস আর মনোরম দৃশ্য।
পুরো ভবন তৈরিতে কোনো প্রকার কলামের ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু সূর্যের আলো যখন সংসদের গায়ে পড়ে, তখন সংসদের দেয়ালে স্পষ্ট হয়ে উঠে কলামের চিহ্ন। নকশা কাঠামোর ভারসাম্য বজায় রাখতে গিয়ে শূন্যস্থানে কোথাও কোথাও ফাঁপা কলাম বসানো হয়েছে।
বাংলাদেশে তখন পছন্দসই উপকরণ পাওয়া ছিল খুবই দুষ্কর। সিমেন্টের সঙ্গে রং মিশিয়ে একটি গাঢ় সবুজ ভাব আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গাঢ় ধূসর রং মেনে নিতে বাধ্য হন কান। কংক্রিটের জয়েন্টগুলো ঢেকে দেওয়া হয় মার্বেল দিয়ে।
লুই কান সংসদ ভবনকে তৈরি করেছেন গোলকধাঁধার মতো। ৯ তলা ভবনে মাত্র তিনটি তলায় সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে ভবনের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যেতে হলে আগেই কানেক্টিং ফ্লোরে যেতে হবে, এরপর যাওয়ার রাস্তা বের হবে। শুধু তাই নয়, সংসদ ভবনের বিশালতার সামনে আসা যাওয়ার পথকে মনে হয় শহরের বিশাল কোন এভিনিউ।
আসলে উপমহাদেশে ঠিক যে ধরনের ভবন সচরাচর দেখা যায়, তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু তৈরি করতে চেয়েছিলেন লুই কান। বাইরে থেকে না কোনো জানালা দৃশ্যমান, না কোনো দরজা। পুরো ভবনটিকে দূর থেকে দেখে মনে হবে যেন বিশাল কোনো পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে। কংক্রিটের বিশাল স্তূপকে ধীরে ধীরে কেটে যেন শিল্পে পরিণত করেছেন তিনি। কংক্রিটের এ শিল্পকে প্রাণ দিয়েছে চারপাশের জলাশয়। কৃত্রিম এ জলাশয় সংসদ ভবনকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত। শহরের বুকে যেখানে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে কংক্রিটের জঞ্জাল, সেখানে প্রকৃতির মাঝে ভবনটিকে মিশে যেতে সহায়তা করেছে কৃত্রিম জলাশয়।
সৃষ্টি শেষ না হতেই স্রষ্টার মৃত্যু
১৯৬৫ সালে শুরু হয় সংসদ ভবনের নির্মাণকাজ। মাঝখানে মুক্তিযুদ্ধের কারণে প্রায় চার বছর (’৭১-’৭৪) বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয়ে ১৯৮৩ সালে শেষ হয় কাজ। তার আগেই ১৯৭৪ সালে ফিলাডেলফিয়ায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন লুই কান। তাঁর নকশা করা শেষ ভবন ছিল সংসদ ভবন। তার মৃত্যুর পর স্থাপত্য অধিদপ্তরের অধীনে শেষ হয় ভবনের বাকি কাজ। পিডব্লিউডির হিসেবে সংসদ ভবন তৈরিতে খরচ হয়েছিল প্রায় ২০০ কোটি টাকা। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য এটি ছিল বিশাল এক বোঝা।
বিখ্যাত স্থপতি ফ্রাঙ্ক লয়েড রাইট বলেছিলেন, ‘একটি ভবন যে যুগে তৈরি, সেই যুগের কথা বলা উচিত।’ সংসদ ভবন তৈরির সময় সেই চিন্তাকে একপ্রকার ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন লুই কান। তাই তো চার দশক পেরিয়েও সংসদ ভবন দাঁড়িয়ে আছে তার আপন মহিমায়, ঠিক লুই আই কানের স্বপ্নের মতো।
তথ্যসূত্র: মীর মোবাশ্বের আলীর সমতটে সংসদ: বাংলাদেশের স্থাপত্য সংস্কৃতি, লুই কান ও সংসদ ভবন
তথ্য সহায়তা: আহ্ছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান এ বি এম মাহবুবুল মালিক ও একই বিভাগের অধ্যাপক ড. শেহজাদ জহির।
(লেখাটি প্রথম আলোর বিশেষ ম্যাগাজিন বর্ণিল বসত জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)