রংপুরের এই রেস্তোরাঁ শিঙাড়া বানিয়েই ৬৩ বছর ধরে জনপ্রিয়

শিং নেই, তবু নাম তার সিংহ। শিং নেই, তবু নাম তার শিঙাড়া। জীবজগতে সিংহকে সমীহ করে সবাই। বনের রাজা বলে ডাকে। জিবজগতে ততটা কদর না হলেও অনেকেরই প্রিয় খাবারের তালিকায় থাকে শিঙাড়া। আবার অনেকে শিঙাড়া পছন্দই করেন না। শিঙাড়ার বিরুদ্ধে যাঁদের অবস্থান শক্ত, তাঁদেরও ভক্ত বানিয়ে দিতে পারে শিঙাড়া হাউসের শিঙাড়া। সেই শৈশব থেকেই রংপুরের রেস্তোরাঁর এই সুখ্যাত খাবারটির ভক্ত রাজীব হাসান

রংপুরের শিঙাড়া হাউসের শিঙাড়া
ছবি: প্রথম আলো

নাটোরের কাঁচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মণ্ডা, বগুড়ার দই কিংবা কুমিল্লার রসমালাইয়ের মতো বিখ্যাত কোনো মিষ্টান্নের জন্ম দিতে পারেনি রংপুর। তবে উত্তরবঙ্গের ছিমছাম শহরটায় বেড়াতে গেলে একবার ঢুঁ মেরে আসতে পারেন শিঙাড়া হাউসে। চোখে এবং চেখে দেখতে পারেন এর শিঙাড়া। চক্ষু-কর্ণ-জিহ্বার বিবাদভঞ্জন তো হবে।

৬৩ বছর ধরে শিঙাড়া বানিয়ে চলেছে এই রেস্তোরাঁ। এত দিন ধরে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে, কোনো একটা ম্যাজিক নিশ্চয়ই আছে।

অবশ্য এই পর্যন্ত পড়ে শিঙাড়া হাউসটিকে কল্পনায় আপনি যেভাবে দেখছেন, আদতে এই রেস্তোরাঁ জাঁকালো নয় মোটেও। বরং কিছুটা জীর্ণশীর্ণ। আয়তনেও ছোট। ভেতরে-বাইরে ছোট আকারের টেবিল-চেয়ার পাতা। গিয়ে যদি দেখেন বড্ড ভিড়ভাট্টা, অবাক হবেন না। শিঙাড়া হাউসে ভিড় লেগেই থাকে। একটু হয়তো অপেক্ষা করতে হতে পারে আপনাকে।

কপাল ভালো হলে যাওয়ামাত্রই আসন পেয়ে যেতে পারেন। আপনাকে কিছু বলতে হবে না, অর্ডার করার আগেই স্টিলের ছোট প্লেটে হাজির হয়ে যাবে শিঙাড়া। প্রথমেই নজর কাড়বে এর আকার। সাইজে শিঙাড়াগুলো বেশ ছোট। আরেকটা ব্যতিক্রমও চোখে পড়তে পারে—সস। শিঙাড়ার সঙ্গে সস আপনি আগেও হয়তো খেয়েছেন। তবে গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, শিঙাড়া হাউস আপনাকে যে সস দেবে, এই সস আপনি চেখে দেখেননি।

আরও পড়ুন
সুস্বাদু শিঙাড়া বানিয়ে বছরের পর বছর টিকে আছে শিঙাড়া হাউস
ছবি: প্রথম আলো

শিঙাড়া ভাঙতেই একটা অ্যারোমা আপনার ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে আঘাত করবে। ঘ্রাণং অর্ধভোজনং কথাটা মিথ্যা মনে হবে। কারণ, এই ঘ্রাণ আপনার ক্ষুধা কমাবে না; বরং বাড়িয়ে দেবে। তরল সসের সঙ্গে শিঙাড়া মিশিয়ে এবার মুখে তুলে নিন। গ্যারান্টি দিয়ে বলছি, আপনার প্লেটের চারটি শিঙাড়া দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। আপনি আরেক দফা খাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠবেন। আবার অর্ডার করার আগেই হাজির হয়ে যাবে আরেক প্লেট শিঙাড়া।

দুশ্চিন্তা করবেন না। শিঙাড়া হাউস অতিথির পকেট কাটায় বিশ্বাস করে না। জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে রুটিরুজি না করার দীক্ষাই বংশপরম্পরায় পেয়ে এসেছেন এই রেস্তোরাঁর মালিকেরা।

একসময় টাকায় চারটি শিঙাড়া পাওয়া যেত এখানে। আমাদের শৈশবে আট আনা, অর্থাৎ ৫০ পয়সায় একটা শিঙাড়া খেয়েছি। সদ্য গোঁফ গজানো তারুণ্যেও এক টাকায় একটা শিঙাড়া বেচতে দেখেছি। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া তখনো টগবগ করত। কী করে শিঙাড়ার দাম তাঁরা কমিয়ে রাখতেন—রেসিপির মতো এটাও ছিল শিঙাড়া হাউসের বিস্ময়গুলোর একটি। বাস্তবতার কাছে হার মানতে মানতে এখন অবশ্য দাম পাঁচ টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে।

আরও পড়ুন
রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শিঙাড়া হাউস
ছবি: প্রথম আলো

শিঙাড়া হাউসের শিঙাড়া কেন আর সবার থেকে আলাদা? এমন প্রশ্ন করলে নিরীহ একটা হাসি উপহার পাবেন ভবতোষ সরকারের কাছ থেকে। তিনিই এখন এই রেস্তোরাঁর মালিক। ১৯৬০ সালে তাঁর বাবা কানাইলাল সরকারের হাত ধরেই যাত্রা শুরু হয়েছিল শিঙাড়া হাউসের। বংশপরম্পরায় ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছেন এবং অবশ্যই গোপন রেখেছেন এর রেসিপি।

আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে, শিঙাড়া বানানোর সময় এর ভেতরে পুর হিসেবে যে আলু-সবজি দেওয়া হয়, তাতে তাঁরা বিশেষ মসলা ব্যবহার করেন। 

এই শিঙাড়া হাউসে বসে মান্না দের কফি হাউসের গানটা মনের ভেতরে আপনা থেকে গুনগুনিয়ে উঠতে পারে। কত কত আড্ডাই না এখানে বসত! রংপুরের নামকরা সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরাও আসতেন।

সময়ের হাত ধরে অবশ্য অনেক কিছুই পাল্টে যাচ্ছে। একচিলতে শহরটাকে বদলে যেতে দেখেছি। বড় বড় ভবন উঠছে শহরজুড়ে। ছুটিতে বেড়াতে গেলে বড় অচেনা লাগে প্রিয় শহরটাকে।

তবে এত সব বদলের ভিড়ে শিঙাড়া হাউস আছে আগের মতোই। ময়দার খোলের ভেতরে যে লুকিয়ে রেখেছে গোপন রেসিপি ও স্মৃতির ঝাঁপি।