খাবারের সঙ্গে দাবাড় ফ্রি

অলংকরণ: তুলি

খাবার নিয়ে মুখরোচক গল্প যেমন আছে, রসিকতাও কম নেই। তবে বাঙালির জীবনে ভাত অক্সিজেনের মতো। মুখরোচক তরকারি পেলে ভাতের হাঁড়ি সাবাড় করতে বাঙালির লাগে কয়েক মিনিট

খাবারের সঙ্গে দাবার। বানানটা একটু পাল্টে দিয়ে ‘দাবাড়’ লিখলেই হয়ে গিয়েছিল আরকি! খাওয়াদাওয়া, কাপড়চোপড়, বইটইয়ের মতো জোড় শব্দ—খাবারদাবার। কিন্তু দাবাড় মানে ধাওয়া করা, তাড়া করা। আমাদের ছোটবেলায় আমরা যখন খেলার মাঠ থেকে কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাইতাম না, তখন আমাদের মুরব্বিরা আমাদের দাবড়ে বাড়ি ফেরাতেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় মুসলিম লীগের এক প্রার্থীকে গরুর হাটে দাবাড় দিয়েছিল এক ষাঁড়, খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছিল, ‘চিনিল কেমনে?’

বাংলাদেশের মানুষেরা প্রাচীন ইতিহাসের কালে খাওয়াদাওয়ার রন্ধনপ্রণালি ইত্যাদি নিয়ে ভীষণ বাদশাহি জীবন যাপন করতেন নাকি একেবারে অতিদরিদ্র ছিলেন, তা নিয়ে বিপরীতধর্মী বিবরণ পাওয়া যাবে। চর্যাপদ–এ আছে দারিদ্র্যের বিবরণ:

‘পাহাড়ের টিলায় আমার ঘর। কোনো প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নেই। কিন্তু নিত্যই অতিথি আসে। দিন দিন ব্যাঙের মতো সংসার বেড়েই চলেছে। কী দুঃখ! দোয়ানো দুধও আবার বাঁটের মধ্যে ফিরে যায়।’

এদিকে মনসামঙ্গল–এ পাচ্ছি রান্নার প্রণালি, লখিন্দরের জন্মের সময় সনকার রান্না:

‘তেঁতুল চলার অগ্নি জ্বলে ধপ ধপ।

নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে মুগের সূপ।।

ধীরে ধীরে জ্বলে অগ্নি একমত জ্বাল।

কড়ির বেগেতে রান্ধে কলাইর ডাল।।

ঝিঙ্গা পোলাকারী রান্ধে কাঁঠালের আঁঠি।

নারিকেল কোরা দিয়া রান্ধে বটবটি।।

আনিয়া বাথুয়া শাক করিল লেচাফেচা।

লাড়িয়া চাড়িয়া রান্ধে দিয়া আদা ছেঁচা।।’

আরও আছে:

‘চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে মিঠা আমের বৌল।

কলার মূল দিয়া রান্ধে পিপলিয়া শৌল।।

কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।

জিরামরিচে রান্ধে চিথলের কোল।।

উপল মৎস্য আনিয়া তার কাঁটা করে দূর।

গোলমরিচে রান্ধে উপলের পুর।।

আনিয়া ইলিশ মৎস্য করিল ফালাফালা।

তাহা দিয়া রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণসাগর কলা।।

রবীন্দ্রনাথের প্রাতরাশের বর্ণনা দিয়েছেন বনফুল: “নীলমণি খাবার নিয়ে প্রবেশ করল। দেখলাম প্রকাণ্ড একটি কাঁসার থালার মাঝখানে রুপোর বাটি দিয়ে কী যেন ঢাকা রয়েছে। আর তার চারপাশে তরকারির মতো কী যেন সাজানো রয়েছে সব। কোনওটাই পরিমাণে বেশি নয়, কিন্তু মনে হল সংখ্যায় অনেকগুলো। বারো-চোদ্দ রকম।…লক্ষ করে দেখলাম মুগের ডাল, ছোলা, বাদাম, পেস্তা, কিসমিস, আখরোট তো আছেই, আরও নানারকম কী আছে, একটা তো উচ্ছের বিচির মতো দেখাচ্ছিল।...নীলমণি দুটো কাঁচা ডিম ভেঙে একটা ডিশে করে দিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ নিজে তাতে গোলমরিচের গুঁড়ো আর নুন দিয়ে নিলেন। নীলমণি দু’টুকরো মাখন-মাখানো রুটিও আনল।

রবীন্দ্রনাথ প্রথমেই ডিশে চুমুক দিয়ে ডিমটা খেয়ে নিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার থেকে দুটো শিশি বার করলেন। একটা দেখলাম মার্কের গ্লুকোজ আর একটা স্যানাটোজেন। দুটো থেকেই দু’চামচ বার করে মেশালেন ক্রিমের সঙ্গে। তারপর কিসমিস পেস্তা সহযোগে খেতে লাগলেন সেটা। পরক্ষণেই কফি এল। কাপে নয়, কেতলিতে। কফি ‘ব্রু’ করার যে বিশেষ ধরনের কেতলি থাকে—তাতে।” রুটিতে অস্ট্রেলিয়া থেকে আনানো মধু মেখে খেলেন কবি। তারপর মুড়ি আর কুসুমবীজ ভাজা। টাটকা খেজুর রস।

এমন নাশতা খেতে পেলে আমি বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় নোবেলটা এনে দিতে যদি না–ও পারি, অন্তত কুস্তিগির পালোয়ান হিসেবে সুনাম এনে দেব—কথা দিচ্ছি।

সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখায় পাই: “আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি—এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি। ইংরেজ খায় মিষ্টি আর নোনা, ঝাল সামান্য, টক তার চেয়েও কম এবং তেতো জিনিস যে খাওয়া যায়, ইংরেজের সেটা জানা নেই। তাই ইংরেজি রান্না আমাদের কাছে ভোঁতা ও বিস্বাদ বলে মনে হয়। অবশ্য ইংরেজ ভালো কেক-পেস্ট্রি-পুডিং বানাতে জানে—তাও সে শিখেছে ইতালিয়ানদের কাছ থেকে এবং একথাও বলব, আমাদের সন্দেশ-রসগোল্লার তুলনায় এসব জিনিস এমন কী, যে নাম শুনে মূর্ছা যাব।”

বাড়িতে জামাই এলে চরে বেড়ানো মুরগি ধরার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপরে, ধরে জবাই করার কাজটাও সারতাম। সেই মুরগির হাঁড়িতে চড়িয়ে মসলাপেষা বাটার পানি ধুয়ে একটু একটু করে দেওয়া হতো। সারা পাড়ায় গন্ধ ছুটত, ওই বাড়িতে মুরগি হচ্ছে আজ।

কিন্তু সাহিত্যে-ইতিহাসে আমাদের খাদ্যের বিপুল গৌরব যতই পাই না কেন, আমাদের শৈশবে আমরা প্রাচুর্য দেখিনি। অবশ্য বাড়িতে গরু ছিল, হাঁস–মুরগি ছিল, কাজেই ডিম-দুধের অভাব হয়নি। আমও অবশ্য আমরা কখনো গুনে খাইনি। এক বালতি আম পানিতে ডুবিয়ে নিয়ে উঠানে টুলে খেতে বসতাম, আম ছিলতাম, দাঁত বসিয়ে খেতে থাকতাম, দুই কনুই বেয়ে কমলা রঙের রস অবিরল ধারায় বইত। বর্ষাকালে সারা বাড়ি আম আর কাঁঠালের গন্ধে ম–ম করত, বড় বড় কাঁঠালের মাছি করত ভনভন। অন্যদিকে কাঁচা ঘরের পেছনে পিড়িলির পাশে জন্ম নিত টক গোলপাতার একধরনের আগাছা, সেই পাতা তুলে চিবিয়ে খেয়েছি; সাদা ফুল হতো একটা ছোট গাছে, ফুল তুলে মধু চুষে খেয়েছি, জঙ্গলে আতাফল পেকে থাকত, পেড়ে এনে খেতাম। ছাতু নামের অখাদ্য খেতে হতো ছোটবেলায়। যেমন জ্বর হলে গিলতে হতো বার্লি কিংবা সাগু। বাড়িতে মেহমান এলে গোল গোল বিস্কুট একটা পিরিচে দেওয়া হতো, অতিথি বিদায় নেওয়ামাত্র আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তাম পিরিচের ওপরে। ভুলে ছাতা ফেলে যাওয়া অতিথি খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে দেখতে পেতেন শিষ্ট ছেলেগুলো আদপে লেজবিশিষ্ট। পাইনঅ্যাপল ক্রিম বিস্কুট বাড়িতে এলে বিস্কুটের দুই খণ্ড আলাদা করে দাঁতে চেঁছে ক্রিমটা আগে খেতাম, বড়রা ধমক দিতেন।

বাড়িতে জামাই এলে চরে বেড়ানো মুরগি ধরার দায়িত্ব পড়ত আমার ওপরে, ধরে জবাই করার কাজটাও সারতাম। সেই মুরগির হাঁড়িতে চড়িয়ে মসলাপেষা বাটার পানি ধুয়ে একটু একটু করে দেওয়া হতো। সারা পাড়ায় গন্ধ ছুটত, ওই বাড়িতে মুরগি হচ্ছে আজ।

কোরবানির ঈদে গরুর চামড়া ছাড়ানোর সময় একটা ঠ্যাং ধরার গৌরব লাভ করতাম। ফ্রিজ ছিল না বলে মাংস জ্বাল দিয়ে ফ্যানের নিচে শুকাতে দেওয়া হতো। তিন দিনের বাসি মাংসের সেই স্বাদ কে কেড়ে নিয়ে গেল?

একবার আমেরিকায় দেড় মাস ভাত এবং বাঙালি বিহনে ছিলাম। কেএফসি বাঁচিয়ে রেখেছিল। দেড় মাস পর ভাত আর মাংসের ঝোল খেয়ে জানি, বাঙালির জীবনে ভাত অক্সিজেনের মতো, ও ছাড়া আমাদের চলে না। আমাদের মেয়ে পদ্য ছোটবেলায় একবার প্রশ্ন তুলেছিল, প্রতিদিন ভাত খেতে হবে কেন? এখন সে পড়ে আমেরিকায়, দেশে ফেরার সময় মাকে হুকুম দেয়, সাদা ভাত, আলুভর্তা আর গরুর মাংস রেডি রাখো।

আল মাহমুদের কবিতায় আছে: “ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগে ভাতের গন্ধ...”

ভাতের গন্ধ আমাদের কাছে মায়ের আঁচলের গন্ধ, চৈত্র মাসে প্রথম বৃষ্টির পর মাটি থেকে ওঠা সোঁদা গন্ধ আর শিশুর মুখের দুধের গন্ধের মতোই প্রিয়। শানকিতে ভাতের সঙ্গে একটু লবণ আরেকটু শুকনো মরিচভর্তাই আমাদের কাছে অমৃত।

খাবারের সঙ্গে দাবাড় বা দাবড়ের সম্পর্ক না বলে লেখাটা শেষ করা ঠিক হচ্ছে না। আমাদের রংপুরে কৌতুক প্রচলিত আছে, মেহমানদের পেট পুরে খাইয়ে বিদায়ের সময় গৃহকর্তা বলছেন: “নিজের বাড়িত বা কেমন খান, এটেকোনা তো ভালয় খাইলেন, এইযে ঘাটা দেখি দিলাম, সোজা বাড়িত যান, আর কোনো দিন না আসিবেন।” (নিজের বাড়িতে কী রকম খাওয়াদাওয়া সারেন, জানি না, এখানে বেশ ভালো খেলেন। ফেরার রাস্তা দেখিয়ে দিলাম। সোজা বাড়ি যান। আর আসবেন না।)