মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? প্রশ্নটি আমার মনে উঠেছিল যখন আমি হাইস্কুলের ছাত্র। কিন্তু ব্যাপারটা ছিল আবছা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার পাশের পাড়ার প্রদীপ নামে এক বন্ধু বিষ পানে আত্মহত্যা করল। আমি দেখেছি তার পরিবারের অবস্থা খুব কাছ থেকে। পরে আত্মহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বিভিন্নভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি বিষয়টি। প্রায় সবাই বলেছে, ‘ওই কথার পর’/ ‘ওই ঘটনার পর আমার খুব অভিমান হলো। আমি আর নিতে পারলাম না।’ জিজ্ঞাসা করেছি, রাগ হয়নি? ‘না। রাগ করে কী লাভ।’ কার ওপর অভিমান হলো—আমার প্রশ্ন। প্রায়ই উত্তর এসেছে, ‘ওপরওয়ালার ওপর, আমার ভাগ্যটাই খারাপ। তাই আমার সঙ্গেই এমন হয়। আর না। আমি আত্মহত্যা করব।’ এ রকমই ছিল বেশির ভাগ উত্তর।
স্বামীর ওপর অভিমান করে স্ত্রীর আত্মহত্যা, পরিবারের ওপর অভিমান করে ছাত্রীর আত্মহত্যা—এমন কতই না শোনা যায়। তাই মনে হয়, রাগ বা দুঃখের চেয়ে অভিমানের অভিব্যক্তি বেশি শক্তিশালী। অভিমান আসে খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকে, যাঁদের ওপর আস্থা, বিশ্বাস আর দাবি থাকে বেশি। এই আস্থা, বিশ্বাস আর দাবি ভঙ্গের জায়গা থেকেই অভিমানের জন্ম হতে পারে। এ জন্য অভিধানে হয়তো এর একটি অর্থ বলা হয়েছে ‘স্নেহহেতুক অনাদরজন্য–চিত্তক্ষোভ।’ খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকেই আমরা অনাদর জনিত মনোকষ্টে ভুগে থাকি আর সেখান থেকেই আামদের অভিমান হয়। দুটো ঐতিহাসিক গল্প বলি, তাহলেই বুঝবেন বিষয়টা।
আমান উল্লাকে হটিয়ে দিয়ে হাবিব উল্লাহ খান ওরফে বাচ্চা খান কাবুলের সিংহাসন দখল করে গ্রাম থেকে নিজের স্ত্রীকে আনতে রোলস রয়েস পাঠিয়েছিলেন। স্ত্রী তখন সন্তানদের যত্ন নিচ্ছিলেন। রোলস রয়েসের ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা খানের স্ত্রী শীতল কণ্ঠে নাকি বলেছিলেন, ‘তোমার মনিবকে গিয়ে বলো, নিজে এসে আমাকে খচ্চরে বসিয়ে যেন নিয়ে যায়।’ সৈয়দ বংশের সন্তান মুজতবা আলী আমাদের জানিয়েছেন, দিগ্বিজয় করে বুদ্ধদেব যখন কপিলাবস্তু ফিরে এসেছিলেন, তখন নাকি যশোধারাও তেমনি করে অভিমান করেছিলেন!
এই হলো অভিমান আর তার গতিপ্রকৃতি। আমরা যত সহজেই বলে ফেলি, অভিমান কোরো না প্লিজ, বিষয়টা তত সহজ নয়। অভিমানের জায়গায় বাচ্চা খানের স্ত্রীই হোন কিংবা যশোধারা অথবা নেপোলিয়নের প্রেমিকা বা আমার স্ত্রী কিংবা আপনার বান্ধবী—সবাই এক কাতারের মানুষ। আচ্ছা, নেপোলিয়নের স্ত্রীর গল্পটা বলা হয়নি, তাই না। বলছি একটু পরে।
আসলে ‘অভিমান’ শব্দটি পুরুষবাচক। এর অর্থ, অহংকার, গর্ব, আত্মসম্মান, মিথ্যা গর্ব (ইত্যাদি)। কিন্তু ‘অভিমানী’ শব্দটি স্ত্রীবাচক। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, আমরা চলতি অর্থে যেভাবে অভিমান শব্দটি ব্যবহার করি সেটি অভিমানী শব্দের পরিপূরক।
খেয়াল করে দেখবেন, অভিমান শব্দটির সঙ্গে নারীদের যোগাযোগ বেশি। পুরুষদের যে নেই, তা নয়। আছে। কোনো কোনো পুরুষের আবার সেটা নারীদের চেয়েও বেশি আছে। কিন্তু গড়পড়তা পুরুষদের কাছে অভিমান একটা ‘মেয়েলি’ ব্যাপার। আদতে এটি মানবিক বিষয়, যার ওপর নারী ও পুরুষ উভয় দলেরই সমান অধিকার। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অভিমান আর আত্মহত্যা—এ দুটোতে নারীরা পুরুষের চেয়ে এগিয়ে। আত্মহত্যা অভিমানের চূড়ান্ত প্রকাশ। দিনের পর দিন মনের ভেতরে ক্ষোভ নামের বাষ্প জমতে জমতে একসময় সেটা বিস্ফোরিত হয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। তার শিকার নারীরাই বেশি। অথচ অভিধান বলছে, আসলে ‘অভিমান’ শব্দটি পুরুষবাচক। এর অর্থ, অহংকার, গর্ব, আত্মসম্মান, মিথ্যা গর্ব (ইত্যাদি)। কিন্তু ‘অভিমানী’ শব্দটি স্ত্রীবাচক। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, আমরা চলতি অর্থে যেভাবে অভিমান শব্দটি ব্যবহার করি সেটি অভিমানী শব্দের পরিপূরক (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। আর একটি বিষয় হলো, অভিমান বা অভিমানী শব্দটির সঠিক ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। যেমন নেই চ্যালেঞ্জ শব্দটির সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ।
পুরুষেরা বহির্মুখী স্বভাবের বলে তারা কোনো ভাবে অভিমানের মতো বিষয়গুলোকে হয়তো সহ্য করে যায় বা ভুলে থাকতে পারে। অথবা হয়তো নিছক পুরুষালি অহংকারের জন্য চেপে যায় বা যেতে পারে। তার ফলও যে খুব ভালো হয়, তা নয়। বিভিন্ন রকমের ডিজ-অর্ডারের শিকার হতে শুরু করে পুরুষেরা। চারদিকে একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই বিষয়টি বোঝা খুব কঠিন নয়।
একুশ শতকের এই কঠিন সময়ে যখন আমাদের সবারই সময়ের অভাব, সবাই যখন নিজের আর পরিবারের জন্য রিলে দৌড়ে শামিল, তখন কে, কোথায়, কেন অভিমান করে বসে আছে, সে খোঁজ রাখা সত্যি কঠিন। শিশুদের বেলায় এটি বেশি হয়ে থাকে। মা-বাবার ব্যস্ত সময়ে শিশুরা খুবই কোণঠাসা হয়ে যায়, অসহায় হয়ে পড়ে। নিজেদের কথা বলতে না পারাটা তাদের ধীরে ধীরে ‘বলতে না চাওয়া’য় পরিণত হয়। কারণ তারা ধরেই নেয়, বাবা কিংবা মায়ের আসলে সময় নেই তাদের দেওয়ার মতো। এ থেকে শুরু হয় শিশুতোষ অভিমানের। তারপর বড় হতে হতে তৈরি হয় দূরত্ব। তখন বাইরের বন্ধুদেরই তারা সব থেকে আপন মনে করে।
কোনটি ঠিক আর কোনটি ভুল, সে হিসেব করা কঠিন। কিন্তু জীবনের জন্য যুদ্ধ করারও একটা ধারা থাকে। থাকা উচিত। সবকিছুতে জিতে যাওয়ার মানসিকতা কিংবা হার না মানার মনোবাসনা আমাদের কতটা উন্নতির দিকে নিয়ে যায়, সেটা বলা কঠিন। আমার এক লেখক বন্ধু আছেন। তিনি পেশাগত জীবনে কাজ করতেন বিমানবাহিনীতে। তাঁর কাছে শুনেছি, যুদ্ধের প্রধান নীতি কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধটা না করার চেষ্টা করা। যুদ্ধে যে জীবন আর সম্পদের ক্ষয় হয়, সেটা উন্মাদেও জানে। আবার আলোকিত সফল মানুষদের জীবনী পড়লে দেখা যায়, কোথাও না কোথাও তাঁরা কিছুটা আপস করেছেন বাধ্য না হয়েও। এই আপাত-আপস করাটা যে যুদ্ধ জয়ের প্রথম ধাপ ছিল, নিবিড় পাঠক মাত্রই তা জানেন। কাজেই জিততেই হবে, সে মানসিকতাতেও আমরা খুব কাছের মানুষদের মনে অভিমানের জন্ম দিয়েই চলেছি। এবার নেপোলিয়নের গল্পটা বলি।
নেপোলিয়নের প্রেম ছিল জোসেফিন নামের এক তরুণীর সঙ্গে। ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু নেপোলিয়ন ধীরে ধীরে যুদ্ধবাজ হয়ে উঠলেন। যুদ্ধে জেতা ছাড়া নিজের জন্য, প্রেম বা প্রেমিকার জন্য তাঁর হাতে সময় ছিল না। তারপরও নেপোলিয়ন প্রেমিকার কাছে চিঠি লিখতেন তাঁর বিজয়ের গল্প জানানোর জন্য। তিনি প্রেমিকা জোসেফিনকে চিঠিতে লিখতেন আজ এ যুদ্ধ জিতলাম তো কাল সে দুর্গ দখল করলাম, এসব। প্রথম প্রথম নেপোলিয়নের চিঠি পড়লেও ক্রমেই জোসেফিন বিরক্ত হতে থাকলেন। ধীরে ধীরে চিঠি না পড়ে ফেলে দিতে শুরু করলেন। কারণ যুদ্ধবাজ বিজয়ী বীর নেপোলিয়নের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও রুচি দুটোই উঠে গেছে তত দিনে। পৃথিবীর অমোঘ সূত্র, প্রকৃতিতে কোথাও শূন্য থাকবে না। হৃদয়ে তো নয়ই। সে সূত্রেই জোসেফিনের মনে জায়গা করে নিলেন নেপোলিয়নেরই এক সেনাপতি। বিজয়ী বীর নেপোলিয়ন হেরে গেলেন মনের যুদ্ধে, প্রেমের যুদ্ধে।
কাজেই ইঁদুর দৌড়ের এ জীবনে লাগাম টানুন। সেরা আর শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠার বাসনায়, সব জিতে যাওয়ার বাসনায় লাগাম টানুন। নইলে জিতে যাবে সেনাপতি। হেরে যাবেন আপনি। অভিমান করে দূরে চলে যাবে কাছের মানুষেরা।