এখনো বাচ্চা নিচ্ছ না কেন?

দম্পতিদের সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিজেদের, এ বিষয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন না করাই ভালো। মডেল: লাবণ্য ও রিয়াদ,ছবি: সুমন ইউসুফ

খুব বিরক্তি নিয়ে প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিলেন নিলুফার। এক সন্তানের এই মা একজন কর্মজীবী। করোনার কারণে এখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। বাসা থেকেই অফিসের কাজ করছেন, সেই সঙ্গে প্রায়ই ছুটিও পাচ্ছেন অফিস থেকে। একজন তাঁকে ফোন দিয়ে একথা সেকথার পর বললেন, ‘বসে আছেন। এই সময়ে আরেকটা বাচ্চা
নিয়ে নেন।’

নিলুফার জানালেন, প্রশ্ন শুনে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘বিয়ের বয়স ১০ বছর। পুরা সময় শুনে আসছি “বাচ্চা কবে নিবা।” প্রথম বাচ্চা হলো, এরপর শুরু হলো, “দ্বিতীয় সন্তান কবে আসবে? শুধু ক্যারিয়ার করলেই হবে, সংসার বড় করতে হবে না?” এখন শুরু হয়েছে, “করোনায় বসে আছ, সময় পেয়েছ, বাচ্চা নিয়ে নাও।”’

আপনি কি বিবাহিত?বিয়ে করতে কেন এত দেরি করছেন?কাউকে পছন্দ?বিয়ের পর বাচ্চা নিচ্ছেন না কেন? দ্বিতীয় বাচ্চা নিয়ে নেন, একটা সন্তান মানে সে খুব একা হয়ে পড়বে, আহারে ওর কি কোনো ভাইবোন হবে না— আসলে এ রকম বিব্রতকর প্রশ্ন করা মানুষের অভাব নেই সমাজে। করোনাকালে এখন যুক্ত হয়েছে, ‘ঘরে বসে আছ, বাচ্চা নিয়ে নাও। এই প্রশ্নে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় মানুষ, তা উপলব্ধি করতেই কথা বলেছিলাম কয়েকজনের সঙ্গে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী এক বন্ধু তো রেগেই গেলেন। বললেন, ‘চাকরি নিয়েই টেনশনে বাঁচি না, আরেকটা বাচ্চা নেব।’

সম্পর্কের গভীরতায় নির্ভর করে ব্যক্তিগত প্রশ্ন

আসলে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে মানুষকে বিব্রত করার অধিকার কি কারও আছে? প্রত্যেক মানুষ আলাদা সত্তা, তারা একসঙ্গে মিলেমিশে একটি সামাজিক পরিবেশ তৈরি করে। তবে ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনতায় তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো তার নিজেকেই নিতে হয়। কারণ দিন শেষে প্রতিটি সিদ্ধান্তের দায়ভার তার নিজের। তাই ব্যক্তিগত প্রশ্নের ক্ষেত্রে সম্পর্কের গভীরতা বুঝতে হয়।

আমাদের দেশে পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পর্কের কোনো বাছবিচার না করার একটা চর্চা রয়েছে। নানাজনের এ ধরনের প্রশ্নের সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত আমরা। এক দম্পতির পেশা ঠিকঠাক থাকুক না থাকুক, তাঁদের বাচ্চা পালনের সামর্থ্য থাকুক না–থাকুক, পরপর বাচ্চা নিতে সামাজিকভাবে তাঁদের ওপর চাপ দেওয়া হয়। ফলে দেখা যায়, পারিবারিক বা পারিপার্শ্বিক চাপে দ্বিতীয় সন্তান নিলেও বাবা-মায়েরা দ্বিতীয় সন্তানকে ঠিকমতো লালন–পালন করতে পারেন না। অনেক সময় দুই সন্তানই হেলাফেলায় বেড়ে উঠতে থাকে। এমনকি এতে ওই শিশুদের নানা রকম মানসিক-সামাজিক সমস্যাও তৈরি হতে পারে। বেড়ে ওঠায় শিশুটি পারিবারিক যত্নও না পেতে পারে। শুধু দুই সন্তানই নয়, একজন সন্তান কিংবা সন্তান ছাড়াও যে পরিবার হতে পারে, সেটা অনেকে মানতে চান না।

উম্মে সালমা (ছদ্মনাম) ব্যাংকে চাকরি করেন। পাঁচ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে তাঁর। পারিবারিক জীবন খুব সুখের নয়। কলহের বিষয়টি মাঝেমধ্যেই ঘরের চার দেয়াল ছাপিয়ে বাইরের মানুষের কানেও পৌঁছায়। তাই অনেকেই এসে পরামর্শ দেন আরেকটা সন্তান নিয়ে নিতে। সালমা বলেন, ‘আমার মা ও বোনেরা মাঝেমধ্যে বলেন আরেকটি সন্তান নিতে। ওদের পরামর্শ, আরেক সন্তান এলে পারিবারিক শান্তি আসতে পারে। আমি অবশ্য তাদের বুঝিয়েই বলি, সন্তান নিলে দেখার কেউ নেই। আমার স্বামী এ বিষয়ে খুব একটা সহযোগিতা করেন না। তবে সত্যি বলছি, প্রতিবেশী ভাবি প্রায়ই পরামর্শ দিতে আসেন, খুব বিরক্ত লাগে। এটা-সেটা বলে এড়িয়ে গেলেও বোঝেন না তিনি। করোনার মধ্যে ফোন দিয়েও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।’

স্কুলে বাচ্চা আনতে গিয়ে এমন বিব্রতকর সমস্যায় পড়তেন সোহানা। বলেন, ছেলের এক বন্ধুর নানি একেবারে সবার সামনে বারবার বলতে থাকেন, ‘একটা বাচ্চা কেন, ওর কোনো সঙ্গী নেই। পরে আফসোস করবে। আমি তো এখন এসে বুঝি যে ভুল করেছি। বাচ্চা একবার হলে লালন–পালন কষ্ট না।’ এমনকি করোনার এই সময়ে ওই নানি ফোন দেন মাঝেমধ্যে তাঁকে। সেই একই কথা। ‘এখনই সময় বাসায় রয়েছ। আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নাও।’

পরিবারের পরিকল্পনা নিজেদের ছকেই থাক

উন্নত বিশ্বে সন্তান নেওয়ার আগে দম্পতির অর্থনৈতিক অবস্থান, সন্তান বড় করার বাস্তবতা মাথায় রেখে পরিবারের পরিকল্পনা সাজান দম্পতিরা। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া সন্তান নিলে তা পরিবারের জন্য ভালো কিছু আনে না বলেই মনে করেন তাঁরা। আসলে আধুনিক সময়ে বংশ বাড়ানোর থেকে সন্তানকে যোগ্য ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা জরুরি। একটা শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার সুযোগ নিশ্চিত করে, তবেই একটি দম্পতির পরিবার পরিকল্পনা সাজানো উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক বলেন, সমাজের অবস্থা এমন, যে কাউকে, যেকোনো ধরনের প্রশ্ন করা হয়। ধরেই নেওয়া হচ্ছে, এসব প্রশ্ন করার অধিকার তাঁর (প্রশ্নকারীর) আছে। বিশেষ করে মেয়েদেরই এ ধরনের প্রশ্নের মুখে বেশি পড়তে হয়। মেয়েটিই পারিবারিক পরিকল্পনা করছে, বাচ্চা নেওয়া বা নেওয়ার দায়টা নারীর, এমনটাই ধরে নেওয়া হয়। একটা চাপ তৈরি করে। প্রশ্নকর্তা বোঝেন না সম্পর্কের আন্তরিকতা বা বন্ধুত্বের জায়গাটা কতটুকু। একটা ট্র্যাডিশনাল জেন্ডার স্ক্রিপ্ট আওড়ে যান তিনি।

এই অধ্যাপকের মতে, এসব চাপ কিন্তু তাঁদের পারিবারিক পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করে। এটা একধরনের পুরোনো চিন্তা যে বসেই আছে, বাচ্চা নিয়ে নিক। এ রকম প্রশ্ন করতে কতটুকু সম্পর্ক থাকা উচিত, তা মানুষ ভাবে না। যাঁকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁর হয়তো নিজস্ব চিন্তা বা ভাবনার জায়গা রয়েছে, এই বাইরের চাপ কিন্তু তাঁকে প্রভাবিত করে, যা তাঁর জন্য ভালো কিছু হয়তো নিয়ে আসে না। তবে মনে রাখতে হবে যাঁর যাঁর নিজের পরিকল্পনা। নিজের ছকে তা সাজানো উচিত। অন্যের চাপে নয়। এখনো এ দেশে বিয়ের পরপরই মাতৃত্বের দায় চাপিয়ে দেওয়ার জন্য স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-মহল্লার মানুষ পর্যন্ত উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়েন। ওই দম্পতিকে কেউ জিজ্ঞেস করেন না যে তাঁরা কী চান।

এটা একধরনের পুরোনো চিন্তা যে বসেই আছে, বাচ্চা নিয়ে নিক। এ রকম প্রশ্ন করতে কতটুকু সম্পর্ক থাকা উচিত, তা মানুষ ভাবে না। যাঁকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁর হয়তো নিজস্ব চিন্তা বা ভাবনার জায়গা রয়েছে, এই বাইরের চাপ কিন্তু তাঁকে প্রভাবিত করে, যা তাঁর জন্য ভালো কিছু হয়তো নিয়ে আসে না।

আসলে আধুনিক সমাজ নতুন করেই ভাবতে শিখছে, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে ভালো–মন্দ যাচাই করতে শিখছে। ফলে অনেক পুরোনো ধ্যানধারণাই পাল্টে যাচ্ছে বা যাওয়া উচিত। তাই অকারণে আরেকজনের দাম্পত্য জীবন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য বা উপদেশ দেওয়ার আগে ভাবা জরুরি।

প্রেম, বিয়ে, সন্তানাদির মতো ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত আলাপ করতে বেশি পছন্দ করেন, সেটা তাঁদের অধিকারের আওতায় না পড়লেও। পুরুষেরাও অবশ্যই এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হন। তবে নারীদের এই প্রশ্নগুলোর মুখে পড়তে হয় বেশি। কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সন্তান প্রজনন ও প্রতিপালনকে নারীদের প্রধান কাজ মনে করা হয়। এমনভাবে নিজের মত দিলেন সংগঠক এবং ফোরসাইট স্ট্র্যাটেজিস্ট তৃষিয়া নাশতারান। তিনি বললেন, ‘জৈবিক কর্মকাণ্ডের বাইরেও যে নারীর আলাদা ব্যক্তিসত্তা এবং স্বাধীন ইচ্ছা থাকতে পারে, এটা অনেকেই মানতে পারেন না। ফলে অবচেতনে বা সচেতনভাবে নারীর কর্মকাণ্ডের ওপর সামাজিক নজরদারি ও খবরদারি প্রকাশ পেতে থাকে। আমাদের অবচেতনের গভীরে প্রোথিত পুরুষতান্ত্রিক ভাবনা এবং সামাজিক চর্চাগুলোকে সচেতনভাবে পরিবর্তন না করলে এই অনধিকার চর্চা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না।’

পরিবার কীভাবে সাজাবেন, তা তো স্বামী–স্ত্রীর একেবারেই নিজস্ব সিদ্ধান্ত। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করতে গেলে সম্পর্কটাও তেমন হওয়া উচিত। অনেকেই আছেন, বিব্রতকর প্রশ্ন করার পর তাঁকে সেটা ধরিয়ে দিলে বলতে থাকেন, ‘আমি তো ওদের ভালোর জন্যই বললাম।’ এদিকে একই রকম বিষয়ে নানাজনের নানা প্রশ্নে স্ত্রী আর স্বামীর জান তো প্রায় যায় যায়। তাই এমন প্রশ্ন করার আগে ভাবা দরকার অন্য মানুষটি বিব৶ত হচ্ছেন কি না, কিংবা চাপ বোধ করছেন কি না।