লম্বা ছুটি শেষে কেন কাজে ফিরতে মন চায় না

ঈদের সময়ের আনন্দগুলো ঈদপরবর্তী সময়ে মনে একধরনের বিষণ্নতা এনে দেয়
ছবি: প্রথম আলো

ঈদের ছুটি প্রায় শেষ। কোরবানির গোশত, কোরমা-পোলাও দিয়ে ভূরিভোজ, আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে আনন্দ, আর ঈদের ব্যস্ততা শেষে সবাইকে আবার যার যার কর্মক্ষেত্রে ফিরে যেতে হবে। আর ঠিক এই সময়টায় অনেকের মনেই একধরনের খালি খালি অনুভূতি বা বিষণ্নতা দেখা দিতে পারে। একেই বলে ‘পোস্টফেস্টিভ্যাল ব্লুজ’ বা উৎসব–উত্তর বিষণ্নতা।

আনন্দযজ্ঞ শেষ হয়ে এলে নিয়মিত জীবনে ফিরে আসাটাকে বিরক্তিকর মনে হয়
ছবি: জুয়েল শীল

পোস্টফেস্টিভ্যাল ব্লুজ আসলে কী

উৎসবের সময়গুলো সাধারণত আনন্দ-উচ্ছ্বাস ও প্রিয়জনদের সঙ্গে হাসি-আড্ডায় কাটে। এই আনন্দযজ্ঞ শেষ হয়ে এলে অনেক সময়ই একধরনের শূন্যতা কিংবা মন খারাপ ভাব ভর করে। নিয়মিত জীবনে ফিরে আসাটাকে মনে হয় বিরক্তিকর। দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজগুলোকেও মনে হয় পাহাড়সম কঠিন। অনেকেরই তখন মনে হয়, সামনে আনন্দের জন্য আর বিশেষ কিছু অপেক্ষা করে নিই।

উৎসব বা আনন্দঘন সময় শেষ হওয়ার পর নিয়মিত জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য যে মানসিক বিষণ্নতা বা শূন্যতা বোধ হয়, তাকেই বলে পোস্টফেস্টিভ্যাল ব্লুজ বা পোস্টফেস্টিভ্যাল সিনড্রোম। পশ্চিমা বিশ্বে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এই বিষয়ে প্রথম মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা ও প্রযুক্তিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটপার্লসের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, কোনো অভ্যাস আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে শরীরে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এটিও তেমনই এক অবস্থা। উৎসবের উল্লাস বা ছুটিতে নেওয়া বিশ্রামের সময়কাল হঠাৎ শেষ হয়ে গেলে মস্তিষ্ক সে ধাক্কা সহজে নিতে পারে না।

এটি কেন হয়?

উৎসবের সময় আমরা আনন্দ, উত্তেজনা, নতুন খাবার, প্রিয়জনদের সংস্পর্শে নিজেদের মগ্ন রাখি। আমাদের মস্তিষ্ক তখন ডোপামিন ও সেরোটোনিন নামক ‘হ্যাপি হরমোন’ ক্রমাগত নিঃসরণ করে। উৎসব শেষে যা হঠাৎ কমে যাওয়ায় একরকম মানসিক ঘাটতি অনুভূত হয়। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অজিত ডান্ডেকার বলেন, যদিও একে কোনো আনুষ্ঠানিক রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তবে এই পরিবর্তনের ফলে মানুষের আচরণ, আবেগ ও শারীরিক অবস্থায় পরিবর্তন আসে।

ডা. ডান্ডেকার আরও বলেন, উৎসব মানেই অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, আনন্দ-উল্লাস, এবং বাহ্যিক উদ্দীপনা। এই আকস্মিক পরিবর্তনের পর যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তখন মন খারাপ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন
এমন পরিস্থিতিতে খাবার খেতেও মন চায় না
ছবি: অধুনা

আপনিও কী এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন?

পোস্টফেস্টিভ্যাল ব্লুজের সাধারণ কিছু লক্ষণ রয়েছে, যা আপনার মধ্যে থাকলে বুঝতে পারবেন আপনিও উৎসব–পরবর্তী মন খারাপ বা শূন্যতা বোধ করছেন। লক্ষণগুলো হলো:

  • হঠাৎ করে মন খারাপ বা খালি খালি লাগা

  • দৈনন্দিন কাজে অনাগ্রহ

  • পুনরায় কাজে ফিরে যাওয়ার অনিচ্ছা

  • ঘুমে অসুবিধা বা অনিয়মিত ঘুম

কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন?

১. ধীরে ধীরে আগের রুটিনে ফিরুন

জোর করে কোনো কাজ শুরু করবেন না। হালকা কাজ দিয়ে শুরু করুন, নিজেকে সময় দিন। মনের ওপর জোর না করে সময় নিয়ে স্বাভাবিক রুটিনে ফিরুন।

২. শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকুন

মনকে হালকা করতে হাঁটাহাঁটি বা যোগব্যায়াম করতে পারেন। রোদে ১০-১৫ মিনিট হেঁটে বেড়ানোও আপনার মন ভালো করতে পারে। এই কাজগুলো এন্ডরফিন হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়, যা বিষণ্নতা দূর করে। প্রতিদিন নিয়ম করে অন্তত ১৫ মিনিট ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন ডা. ডান্ডেকর। এতে ঘুমও নিয়মিত হয়।

৩. চিনিজাতীয় খাদ্য কমান

উৎসবের সময় অতিরিক্ত মিষ্টি গ্রহণ করার কারণে আপনার মুড সুইং হতে পারে। গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, উদ্বেগ বা বিষণ্নতা বাড়ায়। বদলে পুষ্টিকর খাবার যেমন ফলমূল, আমিষ ও শস্য-দানাদারজাতীয় খাবার গ্রহণ করুন।

৪. ছোট ছোট লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করুন

বড় কিছু না করে ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করুন—যেমন নিজের কাজের ডেস্ক গোছানো বা সপ্তাহের কাজ ঠিক করে টু-ডু লিস্ট তৈরি করে ফেলা। ছোট ছোট সফলতা আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, হতাশা কমায়।

আরও পড়ুন
বেড়ানো থেকে ফিরে এসে মন খারাপ হলে নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখুন
ছবি: নকশা

৫. নিজের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন

নিজেকে দোষারোপ করবেন না। মেনে নিন এটা স্বাভাবিক অনুভূতি। নিজেকে সময় দিন। বই পড়তে পারেন, লিখতে পারেন ডায়েরি। চেষ্টা করুন প্রকৃতির মাঝে সময় কাটাতে। এসব আপনাকে মানসিক শান্তি দেবে।

৬. প্রয়োজনে সহায়তা নিন

যদি মন খারাপ বা হতাশা দুই সপ্তাহের বেশি থাকে, কিংবা আপনি অত্যধিক নেতিবাচক চিন্তায় ভোগেন, তবে একজন মানসিক স্বাস্থ্যবিদের পরামর্শ নিতে পারেন। এই সময়টায় পরিবার পরিজনদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর চেষ্টা করন।

৭. সামনের আনন্দ বা উৎসবের পরিকল্পনা করুন

পরবর্তী আনন্দ বা ছুটির পরিকল্পনা অনেক সময় আপনাকে আগেভাগেই সুখস্মৃতি এনে দিতে সাহায্য করবে আর দুঃখ হতাশাও কিছুটা কমাবে। হতে পারে সেটা বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখা, একদিনের ট্রিপ বা নতুন কিছু শেখা।

আনন্দময় উৎসব শেষে শূন্যতা বা মন খারাপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। মনে রাখবেন আপনি একা নন। অনেকেই এমনটা বোধ করে। এটা মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে আগের মতো কাজে ফিরে আসুন। উৎসব শেষ মানেই আনন্দের শেষ না। হয়তো পরবর্তী কোনো উৎসবের পরিকল্পনা শুরু করে দিলেই আনন্দে আবার আপনার মন ভরে উঠবে!

আরও পড়ুন