সন্তান জন্মের পর দাম্পত্য সম্পর্কে অবনতি কেন হয়, সমাধান জেনে রাখুন
সন্তান জন্মের পর অনেক স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্কেই ভাটা পড়ে। দুটি বা তিনটি সন্তান হয়ে গেলে তো কথাই নেই। তখন স্বামী বা স্ত্রী হওয়ার চেয়ে সন্তানের মা–বাবা হয়ে ওঠাটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। নতুন দায়িত্ব, কঠোর পরিশ্রম, নিদ্রাহীনতার ক্লান্তি আর জীবনযাত্রায় বিশাল পরিবর্তন অনেক সময় দাম্পত্য সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি করে। কেন এমন হয়? সমাধান জেনে রাখুন।
১. নতুন দায়িত্বের চাপ
সন্তানের জন্মের পর বেশির ভাগ মা–বাবারই শারীরিক–মানসিক শক্তি ও সময় চলে যায় সন্তানের পেছনে। ফলে একে অপরের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে যায়। দুজন দুজনের প্রথম প্রাধান্যও থাকেন না।
২. বেবি ব্লুজ
মা হওয়ার পর নারীর শরীরে হরমোনের প্রভাবে যে পোস্ট পার্টাম ব্লুজ হয়, সেসবের প্রভাবেও সঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হয়।
৩. ‘ডিফল্ট প্যারেন্টিং’ বা প্রধান অভিভাবকত্ব
অনেক সময় একজন, বিশেষ করে মায়েরা, বেশি পরিমাণ অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করেন। এই ‘ডিফল্ট প্যারেন্টিং’য়ের ভারসাম্যহীনতা বিরক্তি ও অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে। মা যখন সন্তান সামলাতে সামলাতে নিজের শরীর ও মনের যত্ন নেওয়ারই সময় পান না, তখন তিনি সংসারের অন্যান্য দায়িত্ব ও সঙ্গীর চাহিদার দিকে নজর দিতে পারেন না।
আমাদের দেশে প্রায়ই নতুন মায়েদের এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। সেই সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁয়ের মতো যুক্ত হয় জীবনসঙ্গীর অসন্তোষ। নিজেকে নিঃশেষ করে দিয়েও কাউকেও যেন তিনি ঠিক সুখী করতে পারেন না। আর ক্রমেই আটকা পড়েন উদ্বেগ, মানসিক চাপ, রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ ও হতাশার দুষ্টচক্রে।
৪. যৌনজীবনে অসন্তোষ
ক্লান্তি, শরীরের পরিবর্তন এবং সন্তান প্রতিপালনের ব্যস্ততার কারণে যৌনজীবনে আগ্রহ কমে যেতে পারে। এর ফলেও সম্পর্কে দূরত্ব ও ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে।
৫. মতবিরোধ
নতুন পরিস্থিতিতে সন্তান প্রতিপালনের পদ্ধতিসহ নানান কিছু নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিতে পারে, যা ঝগড়ার জন্ম দেয়।
কীভাবে সন্তান জন্মের পরও দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিক রাখবেন
১. নতুন মাকে সাহায্য করুন
মা হওয়ার পর একজন হরমোনের প্রভাবে নানান দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা ও মানসিক চাপ তৈরি হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় সন্তানের যত্ন, পরিশ্রম ও নিদ্রাহীনতার ফলে তৈরি হওয়া নানান জটিলতা। সন্তান জন্ম দেওয়ার ধকল পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে মায়ের সময় লাগে প্রায় দুই বছর।
তাই মায়ের ওপর থেকে চাপ কমাতে সবাই মিলে সাহায্য করুন। আর এ ক্ষেত্রে নতুন বাবার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য সম্পর্কে চাপ সৃষ্টি না করার জন্য নতুন মাকে সব রকম সমর্থন জোগানো খুবই জরুরি।
২. সন্তানের দায়িত্ব দুজন সমানভাবে ভাগ করে নিন
মায়ের ওপর যাতে বেশি চাপ না পড়ে, সেদিকে লক্ষ রাখুন। সন্তানকে বড় করার দায়িত্ব দুজনেরই। মা–বাবা দুজন মিলে একসঙ্গে সন্তানকে সময় দিন। সন্তান রাত জাগলে দুজন দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিন। তাহলে কারও ওপর বাড়তি চাপ পড়বে না। দাম্পত্য সম্পর্কে ভারসাম্য রাখা সহজ হবে। সঙ্গীর প্রশংসা করুন মন খুলে।
৩. সন্তানের বিছানা আলাদা করুন
সন্তানের বয়স আড়াই বা তিন হলেই আলাদা ঘর বা আলাদা বিছানা দিন। প্রাথমিকভাবে সন্তানের যতটা না কষ্ট হবে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাবেন আপনি নিজে। সন্তান দূরে সরে যাবে, এই শঙ্কাও উঁকি দিতে পারে মনে।
তবে গবেষণা জানাচ্ছে, এটি আদতে শিশুর ব্যক্তিত্বের বিকাশ, আত্মনির্ভরশীলতা ও আপনাদের দাম্পত্য সম্পর্ক—সবকিছুর জন্যই উপকারী। শিশুর ঘরটা তার পছন্দমতো সাজিয়ে দিন। রাতে গল্প শুনিয়ে বা বই পড়িয়ে ওকে ঘুম পাড়ান। ঘুমিয়ে গেলে চলে আসুন নিজেদের ঘরে।
৪. ফ্যামিলি টাইম
দিনে এক থেকে দেড় ঘণ্টা রাখুন পরিবারের সবাই মিলে সময় কাটানোর জন্য। হাসি–আনন্দে সময় কাটান। স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গে সন্তানকে সময় দিন।
৫. নিজেদের অনুভূতি নিয়ে খোলামেলা আলাপ করুন
আপনার সঙ্গী কী অনুভব করছেন, তা জানার চেষ্টা করুন। একে অপরের প্রতি খোলামেলা আলোচনা করলে ভুল–বোঝাবুঝি কম হবে।
৬. সম্মান, সমর্থন, সহানুভূতি
ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানই আপনাদের প্রথম প্রাধান্য, এতে সন্দেহ নেই। একসঙ্গে এই নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলা করুন। তবে এ সময় সঙ্গীর আবেগ, অনুভূতি, চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা ও সহানুভূতিশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একে অন্যকে সমর্থন করুন।
৭. ডেটে যান
সপ্তাহে অন্তত এক দিন হলেও নিজেদের জন্য খানিকটা একান্ত সময় বের করুন। দুজন মিলে যা করতে ভালোবাসেন, করুন। একসঙ্গে সিনেমা দেখুন। হাঁটতে বের হোন।
৮. স্পর্শের গুরুত্বকে অবহেলা নয়
যৌনতার অভাব বা অসন্তোষ আপনাদের ভেতর অসন্তোষ তৈরি করতে পারে। একে অপরের প্রতি আকর্ষণ ও ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখার জন্য পরিকল্পনা করুন।
শেষ কথা
সন্তান জন্মের পর দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য সময়টা কঠিন। তবে এই কঠিন সময় চিরস্থায়ী নয়। ধীরে ধীরে আপনারা এই নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবেন। আর সম্পর্কও আবার আগের মতো সুস্থ, এমনকি আগের চেয়ে আরও বেশি মজবুত হয়ে উঠবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন উভয়পক্ষের আন্তরিক সহানুভূতি আর প্রচেষ্টা।
সূত্র: ন্যাশনাল চাইল্ডবার্থ ট্রাস্ট (এনসিটি) ও আমেরিকান প্রেগনেন্সি অ্যাসোসিয়েশন