দুই টিনএজ সন্তানের সিঙ্গেল মা আমি, যেভাবে সামলাচ্ছি ওদের
সন্তানেরা যখন ছোট ছিল, তাদের সামলাতে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। কারণ, শিশুদের একেক বয়সে একেক রকম চ্যালেঞ্জ থাকে। আর সেসব যখন কারও সঙ্গে শেয়ার করতাম, তারা বলত, এ তো কিছুই না। অপেক্ষা করো, কঠিন সময় সামনে আসছে। জিজ্ঞাসা করতাম, সেটি কখন? তাঁরা বলতেন, তাঁদের যখন টিনএজ হবে। তাঁদের কথা শুনতাম, তবে ঠিক উপলব্ধি করে উঠতে পারতাম না। এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কারণ, আমার তিন সন্তানের দুটিই এখন সেই বয়স পার করছে। ছেলে আলিফ আবরাজ ক্লাস নাইনের ছাত্র আর মেয়ে মৌনীরা মীম অষ্টম শ্রেণিতে। এই দুই সন্তান ছাড়াও আমার কোলে এখন সাত মাসের শিশু লাভিসা। সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
একে তো আমি সিঙ্গেল মা, তার ওপর টিনএজ সন্তানদের ঠিক পথে রাখার মানসিক চাপ। হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি তারা বড় হয়ে গেছে। আমরা তাদের পৃথিবীর ভাষা বুঝি না। ওরাও কথা শেয়ার করা কমাতে থাকে, নিজেদের কথা নিজের মধ্যে চেপে রাখতে চায়। এটা আরও ভয়ংকর। ওদের নিজেদের মধ্যে কেমন যেন একটি প্রতিযোগিতা চলে। যা শুরু হয় স্কুল থেকে। আর শিশুটি যদি ভিনদেশি বা আমার সন্তানদের মতো অভিবাসী হয়, তাহলে তো কথাই নেই। আমার ছেলে আবরাজ যখন হাইস্কুলে গেল, অনেক বুলিংয়ের শিকার হলো। কারণ, তার খাবার, চুল ও গায়ের রং আলাদা। প্রথম দিকে কয়েকটি ঘটনা শেয়ার করলেও পরে সেসব আমাকে বলা বন্ধ করে দেয় আমার ছেলে। কারণ, তাদের ধারণা আমরা (অভিভাবকেরা) কম জানি। বিষয়গুলো নিজেরা নিজেরা হ্যান্ডল করতে চায় ওরা। এ থেকেই ঘটে বিপত্তি। নিজেরা ‘কুল’ হতে গিয়ে কূলকিনারা হারিয়ে ফেলে।
এই বয়সের আরেকটি বড় সমস্যা হলো মাদক। সব দেশেই কিশোর বয়সীদের টার্গেট করে মাদক ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা আরও প্রসারিত করেন। এই বয়সে কৌতূহল থেকে একবার মাদকে জড়ালে তার বাকি জীবনটাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তাই সন্তানদের একটু একটু করে মাদকের ভয়াবহতা বোঝানো এই বয়সে সবচেয়ে বড় কাজ বলে মনে হয়।
আগে হয়তো মা–বাবারা মনে করতেন, সন্তান কার সঙ্গে মিশছে সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই তাকে ঠিক পথে রাখা যাবে। আপনি হয়তো পাড়া, মহল্লা বা স্কুলে তার এই মেলামেশার নিষেধাজ্ঞা জারি রাখলেন। এই জমানায় সেটি যথেষ্ট নয়। কারণ, আপনার সন্তানকে আপনি হয়তো বললেন, অমুকের সঙ্গে মিশো না। সে সেটি মেনেও নিল; কিন্তু অনলাইনে সে কার সঙ্গে মিশছে, কার দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, সেটি কিন্তু আপনি জানেন না। গোটা দুনিয়াটাই এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে একটি পাড়া। তাই সেখানে আপনার সন্তান কার দ্বারা প্রভাবিত হবে, কার দ্বারা হবে না বলা কঠিন। একই সঙ্গে এখনকার কিশোর–কিশোরীদের সামনে অনেক অপশন, সময়টা বদলায়ও দ্রুত, তাই ঠিক বা ভুল বিচার করার জন্য যতটা সময় দরকার, সেটি তারা পায় না। যে কারণে প্রতিমুহূর্তে ভয় থাকে—ভুল পথে না সন্তানদের পা চলে যায়। বাস্তব দুনিয়ার মতো এই বয়সীদের কাছে অনলাইন দুনিয়াও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই অনলাইন দুনিয়ার খবর তাদের ভীষণ প্রভাবিত করে। তাদের মতপ্রকাশের ভাষাও বদলে যাচ্ছে। মুখে কোনো কথা না বলেও একটি স্টিকার, ছবি বা মিম দিয়ে পাঁচ মিনিটের বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে এই প্রজন্মের সন্তানেরা। তাই সন্তানদের সঙ্গে তাল মেলাতে অনেক অভিভাবক হিমশিম খান। আমিও যে পুরোপুরি তাল মিলিয়ে চলতে পারছি, সেটি বলা বোকামি; বরং প্রতিনিয়মত অভিজ্ঞতা বাড়ছে, প্যারেন্টিং শিখছি।
আমার সন্তানদের যাতে অলস সময় না কাটাতে হয়, তাই এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত করে দিয়েছি। ছেলে এখানকার ক্লাবে ফুটবল খেলে। মেয়ে তায়কোয়ান্দো বা পিয়ানোর পাশাপাশি ন্যাশনাল থিয়েটার অ্যাক্টিং স্কুলে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। স্কুলের পড়াশোনার বাইরে তাদের এসবে অনেকটা সময় কেটে যায়।
সরাসরি সন্তানের মেলামেশা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও অনলাইনে সেটি সম্ভব না। অনেকে বলেন, ওদের ওদের মতো থাকতে দাও; কিন্তু ওরা তো ওদের মতো থাকে না। বাইরে থেকে যখন ওরা ঝামেলা বাড়ি পর্যন্ত বয়ে আনবে, তখন তো আপনি বসে থাকতে পারবেন না। তখন আপনার প্যারেন্টিং নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই আমার মনে হয়, সন্তান টিনএজ বয়সে আসার আগে মা–বাবার প্রস্তুতি নিতে হবে, সন্তানকে বাস্তব জীবন সম্বন্ধে ধারণা দিতে হবে। অনেক সময় পরিবারে বেশি মানুষ থাকলে এ ক্ষেত্রে সাহায্য হয়। আপনি সন্তানকে সব সময় গাইড করতে না পারলেও বাড়ির বাকি মানুষেরা সেই সময়টা দেখে রাখতে পারেন।
টিনএজ সন্তানের অভিভাবক হিসেবে আমার মনে হয় সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সব সময় তাদের সংস্পর্শে থাকতে পারলে বড় করার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়।