শান্তিতে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের প্রেমের দিনগুলো সিনেমার মতো
বেশ কিছুদিন প্রেমের পর ২০২১ সালের নভেম্বরে বিয়ে করেন পাকিস্তানের নারীশিক্ষা অধিকারকর্মী ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মালালা ইউসুফজাই ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা আসার মালিক। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত হবে মালালার লেখা আত্মজীবনী ‘ফাইন্ডিং মাই ওয়ে’। এই বইয়ে নিজের প্রেম–বিয়েসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন মালালা। বইটির কিছু অংশ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ভোগ ম্যাগাজিনে। সেখান থেকে নির্বাচিত অংশ অনুবাদ পড়ুন।
ফোনালাপের দিনগুলো
যখন আসার (মালিক) আমাকে বলল, সে জুলাই মাসে পাকিস্তান থেকে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসছে, খুব খুশি হয়েছিলাম, যদিও পুরোপুরি অবাক হইনি। তার ভাগনি মেডিকেল স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট করছিল আর ইংল্যান্ডে তখন চলছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপ।
একজন মাঝারি পর্যায়ের ক্রিকেট ম্যানেজারের জন্য এটি ছিল সম্পর্ক ও পেশাগত যোগাযোগ বাড়ানোর দারুণ সুযোগ। কিন্তু আসল কারণ ছিলাম আমি। তাকে কিছু বলার দরকার হয়নি; বুঝতে পেরেছিলাম, এবার তার অনুভূতি বুঝতে আমার ভুল হচ্ছে না।
প্রথম ফোনালাপে তাকে বলেছিলাম অক্সফোর্ডে আমার কী অবস্থা; ক্লান্তি, আতঙ্ক, প্যানিক অ্যাটাক। তার পর থেকে সে প্রায় প্রতিদিন ফোন করত। প্রথমে মূলত আমার শারীরিক অবস্থার খবর নিত, নিশ্চিত করত, আমি আয়রন সাপ্লিমেন্ট খেয়েছি কি না, আর দুই দিন ধরে শুধু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাওয়ার কথা শুনে হালকা বকাও দিত। ধীরে ধীরে আমাদের কথোপকথন দীর্ঘ হতে লাগল। সেলিব্রিটি ক্রাশ থেকে ছোটবেলার স্বপ্ন—সবকিছু নিয়েই আমাদের কথা হতো।
আসার আমার বন্ধুদের প্রেমের গসিপও জানত। জানতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে সে ডিজে ভালোবাসত, কিন্তু লাহোরে এক অবৈধ রেভ পার্টিতে খুনের ঘটনা চোখের সামনে দেখার পর থেকে সেটা সে ছেড়ে দেয়। বেশির ভাগ বন্ধুর মতো আমিও ফোনের চেয়ে খুদে বার্তা চালাচালি করতেই স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু আসারের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারতাম।
চুটিয়ে প্রেম করার দিনগুলো
আমাদের সম্পর্ক তত দিনে আর শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিষয়টা আমরা দুজনই বুঝে গিয়েছিলাম। সে আমাকে ‘বেব’ বলে ডাকত। আমার পাঠানো ছবি দেখে বলত, ‘তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে।’
আগে ডেটিংয়ের অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক সময় মনে হতো, আমি যেন ২৯ বছর বয়সী একজন পুরুষের সঙ্গে কিশোরীর মতো উচ্ছ্বাসে প্রেম করতে চাইছি। সে (আসার) যদি কোনো দিন খুদে বার্তায় জানাত আজ কাজের চাপে ব্যস্ত, তাই নির্ধারিত সময়ে ফোন করতে পারবে না, তখন অভিমান করতাম। উত্তরে লিখতাম, ‘তোমার তো এখন আমার জন্য সময়ই নেই। হয়তো আমি তোমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ নই।’
তার মনোযোগ পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করেই ঝগড়া বাধানোর চেষ্টা করতাম। আমার এমন আচরণে সে হেসে ফেলত। আমাকে বলত ‘ড্রামা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট’, সঙ্গে জানাত, সে–ও আমাকে মিস করছে।
লন্ডনে আসার কয়েক সপ্তাহ আগে সে আমাকে এক রাতে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার গ্রীষ্মকালীন ব্যস্ত সময়ের মধ্যে আমরা কতটা সময় একসঙ্গে কাটাতে পারব? ইথিওপিয়া আর ফ্রান্সে দুটি ছোট্ট সফর আর আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘ সময় থাকা—আমার ক্যালেন্ডারে এর বাইরে অনেকটা সময় ফাঁকা আছে, আর সব তোমার জন্যই বরাদ্দ! তবে আমি তোমার মা–বাবাকে নিয়ে চিন্তিত।’
জানালাম, হ্যাঁ। গত বছর হয়তো তাঁরা বেশি জিজ্ঞেস করেননি, কিন্তু আমরা যত বেশি দেখা করব, তাঁরা তত বেশি প্রশ্ন করবেন। বিষয়টা একটু জটিল হতে পারে।
আসার জানাল, ‘ঠিক আছে, আমি তাহলে তোমার বাবাকে একটা চিঠি লিখি? সেখানে বলব, “প্রিয় মিস্টার ইউসুফজাই, আশা করি ভালো আছেন। আপনি হয়তো খেয়াল করেছেন, আপনার কন্যা এখন চমৎকার ও সুন্দরী এক নারী হয়ে উঠেছে। আর…।”’
এরপরই আসার হেঁড়ে গলায় গাইতে লাগল, ‘লে জায়েঙ্গে, লে জায়েঙ্গে, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে!’
বলিউডের একসময়ের এই জনপ্রিয় গান মূলত প্রেমিক তাঁর হবু শ্বশুরের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে গেয়েছিলেন।
ওর এই গান শুনে আমার মাথায় দুটি ভাবনা এল—১. ওকে দেখার জন্য আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। ২. সম্ভবত আমি এর চেয়ে খারাপ সুরের গান আর শুনিনি।
লং ড্রাইভে
যেদিন আসার ইংল্যান্ডে এল, সেই মুহূর্ত থেকেই আমাদের গ্রীষ্মের খুনসুটি-ঝগড়া আর সম্প্রতি চার ঘণ্টার ফোনালাপের অভিজ্ঞতা মিলে নতুন এক উত্তেজনা তৈরি হলো। তখন আমরা সারা দিন একসঙ্গে কাটাতাম। তারপর বাসায় ফিরেই আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলতাম। লন্ডনের দিকে লং ড্রাইভে বেরিয়ে আমরা চমৎকার অনুভূতি নিয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। পাশাপাশি থাকতে পেরেই খুশি হতাম। আমরা রাস্তার পাশের গ্রামের দৃশ্য উপভোগ করতাম আর আমার নিরাপত্তারক্ষীদের বাজানো নব্বইয়ের দশকের গান শুনতাম।
এক সন্ধ্যায় আমরা ইংল্যান্ডের ওল্ড মানরের এক রেস্তোরাঁয় গেলাম। হোস্ট যখন আমাদের জানালার পাশে টেবিলে বসিয়ে দিল, আমি আসারের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এক মিনিট, আসছি।’
আমি যখন বাসা থেকে বের হই, মায়ের কথামতো সালোয়ার-কামিজ পরে এসেছিলাম। কিন্তু আলাদা করে ব্যাগে এনেছিলাম হালকা গোলাপি লেইস দেওয়া ফর্ম-ফিটিং স্লিভলেস ড্রেস ও সবচেয়ে উঁচু জুতাজোড়া।
সেটা পরে যখন টেবিলে ফিরে এলাম, আসার নড়েচড়ে বসল। আর তার মুখে এমন হাসি ফুটল, যা আগে কখনো দেখিনি। সে আমার চেয়ারটা টেনে দিল আর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি একেবারে সেক্স বম্ব!’ আমি লজ্জা ও খুশিতে মুখ লুকালাম ডিনার ন্যাপকিনের আড়ালে।
ধরা পড়তে গিয়ে বেঁচে ফেরা
অক্সফোর্ডে আমার তৃতীয় সেমিস্টার নিয়ে চোখে যে অন্ধকার দেখছিলাম, আসার আসায় সেটা অনেকটা কেটে গেল। তবে এটা ঠিক, আমাদের এই সময়ের প্রেমের পুরোটা গ্রীষ্মকালীন রোমান্টিকতায় ভরপুর ছিল না। কারণ, ধরা পড়ে যাওয়া নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
একদিন বিকেলে লন্ডনের চিজাক গার্ডেনসে হাঁটতে হাঁটতে আসারকে নিজের প্রতিভা দেখাতে গিয়ে একটা গাছে চড়লাম। এরপর তাকে ডেকে বললাম, দেখি তুমি আমাকে ধরতে পারো কি না। এরপর যখন গাছ থেকে লাফিয়ে নেমে এলাম, তখন ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিলাম। আর এই সময়েই আমার নজর পড়ল পার্কের বেঞ্চে বসা একজন নারীর দিকে, যিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আমাকে চিনতে পেরে তিনি চওড়া একটা হাসি দিলেন এবং ছবি তোলার জন্য ফোন বের করলেন। দ্রুত দৌড়ে গিয়ে একটি ঝোপের পেছনে লুকালাম। এতে আসার ও আমার নিরাপত্তা দলের সবাই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
বাবাকে যেদিন বললাম
পরের দিন বাবার সঙ্গে বিমানবন্দরে যাচ্ছিলাম, আমাকে আদ্দিস আবাবা যাওয়ার ফ্লাইট ধরতে হবে। মনে হলো, আর দেরি না করে আসারের কথাটা আজ বলেই ফেলি। বাবা তখন ফোনে সকালের খবর পড়ছিলেন আর আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে ভাবছিলাম, কীভাবে বলব। একই সঙ্গে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি তাঁর প্রতিক্রিয়ার জন্য। যদিও আরও কিছুদিন বিষয়টা এভাবে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেটা তো লম্বা সময় পর্যন্ত চলতে পারে না।
বাবা আর আমি রাজনীতি, বিশ্বের নানা ঘটনা, নারীবাদসহ যেকোনো বিষয় নিয়েই তর্ক করতে ভালোবাসি। সব সময় চেষ্টা করতাম তাঁকে আমার দিকটা বোঝাতে, বেশির ভাগ সময়ই সেটা পারতাম। সব সময় মনে হয়েছে, আমি বাবাকে যেকোনো কিছু বলতে পারি, কিন্তু আগে কখনো প্রেমে পড়িনি।
শুরুটা করলাম এভাবে, ‘বাবা, তুমি জানো…একটা ভালো মানুষ খুঁজে পাওয়া কতটা কঠিন…। মানে ধরো, এমন কেউ, যার রসবোধ আছে, আবার সে আমাকেও বুঝবে।’
এবার বাবা আমার দিকে মনোযোগী হলেন। যেন আমাকে বোঝার চেষ্টা করছেন। মনে মনে বললাম, ‘উফ্, তুমি এভাবে তাকিয়ে বিষয়টা আরও কঠিন করে দিচ্ছ!’
তারপর নিজেকে বললাম, চুপচাপ বলে ফেলো।
তারপর বলতে শুরু করলাম, ‘এমন হয় না…যখন কারও সঙ্গে কথাটথা হয়, তার সঙ্গে আরও অনেকটা সময় কাটাতে চাই আমরা? আচ্ছা, আমার মনে হয়…মানে, আসলে আমি এমন একজনকে খুঁজে পেয়েছি। তার বয়স ২৯…লাহোরে থাকে, গ্রীষ্মে তার বোনের সঙ্গে দেখা করতে ইংল্যান্ডে আসে। আর সে ক্রিকেট নিয়ে কাজ করে, যেটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয়।’
বাবা ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, এখন পর্যন্ত যা বলেছি, তাঁর কাছে ঠিকই লাগছে। আমি বলে যেতে লাগলাম, ‘আমরা, মানে আমি আর আসার...আমি তাকে পছন্দ করি, বাবা। সত্যিই পছন্দ করি…প্রেমের দৃষ্টিতে।’
কথাটা মুখে আনতেই বুকের ভেতর অদ্ভুত একটা কাঁপুনি উঠল। কিন্তু বাবা নিঃশব্দে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, একবারও চোখের পলক না ফেলে।
‘চেয়েছিলাম তুমি বিষয়টা জানো’—আমি বলতে লাগলাম, ‘কিন্তু দয়া করে মাকে কিছু বোলো না। অনুরোধ করছি; কারণ, এখনো (মায়ের সঙ্গে) কোনো ঝগড়ার জন্য প্রস্তুত নই।’
প্রথমে মনে হলো, বাবা কোনো প্রশ্ন করতে যাচ্ছেন। কিন্তু নিজেকে থামালেন, সামনে তাকালেন আর কিছু বললেন না। তারপর অবিশ্বাসের সঙ্গে দেখলাম, আমার বাবা, আমার জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি, ফোন বের করে বাড়িতে কল করলেন।
আমি শুনছি ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে মা বলছেন, ‘একদমই না। সে (আসার) কি পশতু বলতে পারে? ওকে (মালালা) অবশ্যই একজন পশতুন ছেলেকে বিয়ে করতে হবে।’
বাবা ফোন কেটে দিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বললেন, ‘যদি সে গ্রীষ্মে এখানে থাকে, আমাদের তাকে দেখা উচিত। কিন্তু তোমার গ্র্যাজুয়েশনের আগে কোনো বাগ্দানের ঘোষণা করা হবে না।’
আমি দ্রুত জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে নিজের ওপর রাগ করলাম, বাবার ওপর রাগলাম মাকে ফোন করার জন্য, মায়ের ওপর রাগ হলো এত ছোট মানসিকতার জন্য আর দুজনের ওপরই রাগ হলো বাগ্দান ও স্বামী সম্পর্কে আলাপের জন্য।
দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন নিচের লিংকে