কম বয়সে নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের টালমাটাল প্রেমের দিনগুলো

বেশ কিছুদিন প্রেমের পর ২০২১ সালের নভেম্বরে বিয়ে করেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী মালালা ইউসুফজাই ও পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের কর্মকর্তা আসার মালিক। ২১ অক্টোবর প্রকাশিত হবে মালালার লেখা আত্মজীবনী ‘ফাইন্ডিং মাই ওয়ে’। এই বইয়ে নিজের প্রেম-বিয়েসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন মালালা। বইটির কিছু অংশ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘ভোগ’ ম্যাগাজিনে। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু অংশের অনুবাদ গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। আজ পড়ুন বাকি অংশ।

বিয়ের দিন মালালা ইউসুফজাই ও আসার মালিকছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

পশতুন নিয়ম ভাঙা তরুণী

আমি চিৎকার করে বলতে চাইছিলাম, ‘তোমরা কেন বিয়ের চিন্তা করছ? ২১ বছরের অন্য কলেজ শিক্ষার্থীদের মতো আমি কি আমার জীবনযাপন করতে পারব না!’

কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর আমার নিজেরই জানা আছে। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাবা-মা কখনো আমাকে বিয়ে করতে বলবে না, আবার তারা এটাও মেনে নেবে না যে আমার একজন প্রেমিক আছে।

দেখা করা যাবে না, স্পর্শ করা যাবে না, কোনো ডেটিংও না—বিয়ের আগে কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বললেও তা বাবা-মায়ের চোখের সামনে হতে হবে; এটাই ছিল পশতুন নিয়ম। আর আমি এরই মধ্যে সব নিয়ম ভেঙে ফেলেছি।

শুরুতে মালালার প্রেম নিয়ে পরিবারের আপত্তি ছিল
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

(আসার আমার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসার দিনের) সব যেন মিনিট ধরে হিসাব করা হয়েছিল। আসার ১১টা ৪৫ মিনিটে ট্রেনে করে বার্মিংহামে পৌঁছাবে, ১২টায় আমাদের বাড়িতে লাঞ্চ করতে আসবে আর ১টায় লন্ডনে ফিরে যাবে। আমি ভাবছিলাম, এই এক ঘণ্টায় খুব বেশি ভুল হওয়ার আশঙ্কা নেই।

ফুল নিয়ে সে আমাদের বাড়িতে পৌঁছাল। তাকে কিছুটা নার্ভাস মনে হচ্ছিল। আমি নিজেও লজ্জা পাচ্ছিলাম, চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারছিলাম না। তাকে লিভিংরুমে নিয়ে গেলাম, যেখানে আমার ভাইয়েরা (খুশাল ও আতল) ড্রিল র‍্যাপ বাজাচ্ছিল এবং ভিডিও গেম খেলছিল।

আরও পড়ুন

বাড়ির পরিবেশ

প্রথমবার দেখা হওয়ার সময় মালালার মা আসারকে অনেক সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করেন
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

আমার বাবা ভুল করে ওই দিন দুইটা আয়োজন একসঙ্গে ফেলেছিলেন। (আসারের বাইরেও) তিনি নিজে সাতজন অতিথিকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বাগানে বারবিকিউ আর চায়ের পাশাপাশি নানা বিষয়ে খোশগল্প চলছিল। গাছের নিচের লনে একটি চেয়ারে বসে সবাইকে, বিশেষ করে আসারকে, পর্যবেক্ষণ করছিলেন মা।

তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পশতু জানো? সে সাহস দেখিয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিছু বাক্য বলল। শুনে মা বিশেষ মুগ্ধ হননি, তবে সে যে চেষ্টা করেছে, তাতেই মনে হলো তিনি কিছুটা সন্তুষ্ট হলেন। পুরো পরিস্থিতিটা আমাকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তুলছিল।

তবে বাবা ও তাঁর অতিথিদের সঙ্গে গ্রিল করার কৌশল নিয়ে কথা বলে বেশ স্বস্তি পেয়েছিল আসার। সে খুশালকে পড়াশোনা নিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিল আর আতলের সঙ্গে বিটবক্সও করছিল।

ঠিক একটায় তার জন্য একটি গাড়ি ডাকলাম। সে বের হওয়ার সময় কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ‘দুঃখিত।’ সে চলে যাওয়ার পর বুকের ওপর থেকে একটা ভার যেন নেমে গেল। সহজে শ্বাস নিলাম। কারণ, এতক্ষণে আমার দুটি আলাদা পরিচয় যেন যে যার নিজেদের ঘরে ফিরেছে।

একটি পরিচয় মা-বাবার পূতপবিত্র পশতুন কন্যা, আরেকটি পরিচয় আসারের চেনা মজা করতে ভালোবাসা প্রেমিকা। কিন্তু এই স্বস্তি খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। বুঝতে পারছিলাম না, পরবর্তী কয়েকটা সপ্তাহ ওকে (আসার) ছাড়া কীভাবে থাকব।

আরও পড়ুন

চিকিৎসার দিনগুলো

প্রেমের সময়েই দুজনে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

পরদিন সূর্য ওঠার আগেই মা-বাবার সঙ্গে হিথরো বিমানবন্দরে গেলাম। সেখান থেকে বোস্টনের বিমান ধরলাম। তাঁরা আমাকে ডা. টেসা হ্যাডলকের সঙ্গে দেখা করাতে ম্যাসাচুসেটস আই অ্যান্ড ইয়ার-এ নিয়ে যাচ্ছিলেন।

তিনি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের প্রফেসর ও মুখের প্যারালাইসিস চিকিৎসায় অগ্রণী। ডা. হ্যাডলকের তত্ত্বাবধানে ক্রস-ফেশিয়াল নার্ভ গ্রাফট নামে আমার একটি জটিল ধারাবাহিক অস্ত্রোপচার চলছিল। এটা সফল হলে আমার মুখের বাঁ দিক আরও সচল হবে।

শুরুতে আমি এই ক্রস-ফেশিয়াল নার্ভ গ্রাফট করতে চাইনি। কারণ, এটি করানো মানে পরপর তিনটি গ্রীষ্ম সপ্তাহজুড়ে হাসপাতাল ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে কাটানো। তবে মা-বাবা চেয়েছিলেন আমাকে প্রথমবার বার্মিংহামের হাসপাতালে দেখা তাঁদের সেই স্মৃতি (তলিয়ে যাওয়া চোখ, প্যারালাইজড মুখ) মুছে যাক, সেই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও অনলাইনে ট্রলকারীদের থামাতে চেয়েছিলেন, যারা বলত, গুলি চালানোর আগে তুমি কত সুন্দরই না ছিলে।  

‘ফাইন্ডিং মাই ওয়ে’ হাতে মালালা
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

বিমানে আসারের কাছ থেকে একটি খুদে বার্তা পেলাম, ‘তোমার মা-বাবা আমাদের সম্পর্কে কিছু কি বলেছেন?’ আমি সত্যিটাই জানালাম, ‘তাঁরা কিছুটা চিন্তিত।’ তাঁরা ভয়ে ছিলেন, ভেবেছিলেন গোপনে কেউ আমাদের ছবি তুলতে পারে বা আমাদের বন্ধুদের মাধ্যমে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যেতে পারে। কোনো একটি কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটার আগেই তাঁরা চেয়েছিলনে আমি তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করি। আমি সেটা করতে চাইনি, আমার বরং বিরক্ত লাগছিল যে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে।

আমি যা চাইছি তাতে কি তাঁদের খুশি হওয়া উচিত ছিল না? বিমানে আমি সাধারণত বাবার পাশে বসি, আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করি। তবে এবার আমি মুখের ওপর একটি কম্বল টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভাগ্যক্রমে, সেবার অস্ত্রোপচার সফল হলো। ঘুম থেকে উঠতেই হাসপাতালের জানালা দিয়ে আসা রোদে পুরো শরীরে একটা আরামদায়ক অনুভূতি। মনে মনে ভাবলাম—‘তুমি সফল হয়েছ।’

আরও পড়ুন

টান টান ডিনার ডেট

বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় একসঙ্গে খেতে দেখা যায় মালালা ও আসারকে
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

লন্ডনে ফিরে আসারের সঙ্গে দেখা করলাম। সে লাহোরে ফিরে যাওয়ার আগে ডরচেস্টার হোটেলের একটি ক্যান্টোনিজ রেস্তোরাঁয় আমরা রাতের খাবার খেলাম। সার্জারির কারণে তখনো আমার মুখ বেশ ফোলা। কিন্তু সে আমাকে দেখে সেই একই রকমভাবে হাসল, যেভাবে গ্রীষ্মের শুরুতে আমাকে ‘সেক্স বম্ব’ ড্রেস পরা দেখে বিস্মিত হয়েছিল।    

সম্পর্ককে কোনো বিশেষ সংজ্ঞায় না ফেলে মাসের পর মাস সেটাকে আমরা এগিয়ে নিয়েছি। শুধু একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করেছি, মনে মনে ভেবেছি সবকিছু যেমন আছে, ঠিক তেমনই থাক। এভাবে থাকাটা নিজেও পছন্দ করতাম, তবে গত কয়েক সপ্তাহ তাকে না দেখে আমার অনুভূতি আরও তীব্র হয়ে উঠল।

জানতে চাইছিলাম, ওর কেমন লাগছে। ডিনারের দিন বারবার প্রশ্নটি করতে চেয়েছি, কিন্তু শেষমেশ পারিনি। তবে সে অবশ্য বুঝতে পেরেছে, আমি কী চাই।

ভ্যানিটি ফেয়ারের পার্টিতে মালালা ও আসার
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

সে বলল, ‘চলে গেলে তোমাকে অনেক মিস করব। সপ্তাহে একবারও তোমাকে না দেখলে অনেকটা শূন্য শূন্য লাগবে। তুমি জানো, দ্বিতীয়বার আমাদের দেখা হওয়ার সময় বলেছিলাম একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে যেতে চাচ্ছি।’ এটা বলে সে কিছুক্ষণ থামল আর আমার বুকের মধ্যে ধুকধুক করতে লাগল। এবার কী বলবে! সে কি প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে, নাকি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলবে?

সে বলল, ‘সত্যি কথা বলতে, চাইলে কালই তোমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, তবে সেই প্রস্তাব তোমাকে এখনই দেওয়াটা ঠিক মনে করছি না। কারণ, এটা তোমার ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া হবে। তুমি এখনো অনেক ছোট। তুমি এখনো প্রতিদিন বদলাচ্ছ, জীবন থেকে ঠিক কী চাও—এখনো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছ।’
ওই সময়ে তার কথাগুলো এতটা সংবেদনশীল ছিল যে আমি সেটা স্বীকার করার জন্য অপেক্ষা করতে পারছিলাম না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি ভাবছ আমি ছোট বলে নিজের অনুভূতি বুঝতে পারি না? তাহলে তুমি ২৯ বছর বয়সে এসে কীভাবে বুঝলে যে তুমি কাউকে ভালোবাসো?’
সে জানাল, ‘আমি নিজেকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম।’

প্রশ্নগুলো এমন, “ওর সঙ্গে সময় কাটাতে কি আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে? ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলাটা কি উপভোগ করি? ওকে কি বিশ্বাস করি? ডরচেস্টার হোটেলের ক্লোকরুমে (গরম কাপড় জমা রাখার ঘর) ওকে চুমু খেতে ইচ্ছে করে?”’

‘তুমি এখনো প্রতিদিন বদলাচ্ছ’ মালালাকে বলেছিলেন আসার মালিক
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

ওর কথা শুনে আমার মুখ লাল হয়ে গেল, কথা বলতে গিয়ে যেন ধাক্কা খেলাম। তারপর সাহস করে বললাম, ‘তাহলে…আপাতত… ধরো আমরা একটা খোলা সম্পর্কে আছি, তবে তোমার দিক থেকে সম্পর্কটা আরেকটু বেশি কিছু।’

শুনে আসার এত জোরে হেসে উঠল যে পাশের টেবিলের লোকজন আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখল।  

তারপর বলল, ‘মজার কথা, কিন্তু এটাও তো সমস্যার অংশ। তুমি আমাকে তোমার প্রেমিকও বলতে চাও না। কারও জীবনে “গোপন ব্যক্তি” হয়ে থাকা ভালো লাগবে না, বিশেষ করে যখন আমি চাই সবাই জানুক তুমি কত অসাধারণ। আমি তোমাকে নিয়ে সমুদ্রসৈকতে ছুটি কাটাতে চাই, দুজনের ছবিতে ফোনের গ্যালারি ভরে ফেলতে চাই। কিন্তু জানি না, সেটা কবে হবে বা আদৌ হবে কি না।’

বললাম, ‘এই গোপনীয়তাটা আসলে আমার মা-বাবাকে শান্ত রাখার জন্য। তারা ভয় পায়, পাছে কোনো কেলেঙ্কারি না হয়ে যায়।’  

আসারের সঙ্গে মালালার দেখা হতো বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে
ছবি: মালালা ইউসুফজাইয়ের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে

সে ঝুঁকে আমার হাতটা ধরল, ‘আমি সব সময় তোমার গোপনীয়তা রক্ষা করব, সব সময়। কিন্তু সত্যি বলতে মালালা, আমি মনে করি তুমি এটা গোপন রাখছ, কারণ এখনো তুমি নিশ্চিত নও জীবনে কী চাও, আমার কাছ থেকেই-বা কী চাও। এটা ঠিক আছে! কারণ, এই অনিশ্চয়তা বয়স বাড়লেও যায় না। জীবন পরিচালনায় কোনো দিকনির্দেশনার চিহ্ন থাকে না। কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত জীবন চালাতে পারে না, ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া বা হৃদয় ভাঙার আশঙ্কা সব সময় থেকেই যায়।’

আমি পোশাকের হাতা টানতে টানতে পুরো গ্রীষ্মে প্রথমবারের মতো তাঁর সামনে হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ‘আমরা কি সাময়িক বিরতি নিতে পারি? শুধু তত দিন, যত দিন আমি অক্সফোর্ড-অধ্যায় না শেষ করছি। তারপর আগামী জুনে এখান থেকেই আবার শুরু করব, দেখব কোথায় যায়।’

আসার হেসে বলল, ‘আমার মনে হয় না, অনুভূতিগুলোকে এভাবে “পজ” করে রাখা যায়। তবু তোমার জন্য আমি চেষ্টা করব।’
হোটেল লবির এক কোণে অল্প আলোয় এসে বিদায় বলার জন্য দাঁড়ালাম। সে যখন আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল, ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

(শেষ)

আরও পড়ুন