অন্তত এক বেলা সবাই একসঙ্গে খাওয়াটা কেন জরুরি

নিয়মিত খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসলে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়। মডেল: বাবু, জুলফিকার, জাইন, রিনু, সিমি
ছবি : সুমন ইউসুফ

দুপুরে গোসলের পর ও রাতে সবার খাবার টেবিলে হাজির হওয়া ছিল মৃন্ময়ীদের বাড়ির নিয়ম। বাসার ছোট যে সদস্য, সে বছর পাঁচেক বয়স পর্যন্ত খেত বাবার সঙ্গে বড় থালায়। একেক পদ দিয়ে ভাত মেখে থালার এক পাশে আলাদা করে দিত বাবা। এভাবেই তারা সব ভাইবোন সব ধরনের খাবার খেতে শিখেছে। খাবার টেবিলটা ছিল তাদের পরিবারের মূলমঞ্চ। খাবারের পাশাপাশি সেখানে চলত সারা দিনের গল্প। সারা দিন কে কী করল, তার বয়ান থেকে শুরু করে জরুরি কোনো আলোচনা, সিদ্ধান্ত ইত্যাদিও এ টেবিল থেকেই জেনে যেত সবাই। অনেক সময় দেখা যেত, খাওয়া শেষ, হাত শুকিয়ে গেছে কিন্তু গল্প শেষ হচ্ছে না। এভাবে বড় হয়েছেন মৃন্ময়ীরা।

মৃন্ময়ীর নিজেরই এখন সংসার হয়েছে। সন্তানও আছে। কিন্তু মৃন্ময়ীর ছোটবেলা আর তাঁর সন্তানের ছোটবেলার মধ্যে কত ফারাক! মৃন্ময়ী আর তাঁর স্বামী, দুজনই চাকরিজীবী। দিনের একটা লম্বা সময় বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। সন্তান থাকে গৃহকর্মীর কাছে। চাইলেও মৃন্ময়ীর এখন আর সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে খাওয়া হয় না। শুধু মৃন্ময়ীই নয়, অধিকাংশ পরিবারেই এখন এই চিত্র।

চিকিৎসক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এতে করে নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। মৃন্ময়ীরও যেমন হয়েছে। ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে, এমন ঘটনা খুব কম। অথচ এখন মৃন্ময়ীর প্রায়ই ছুটতে হয় বদ্যিবাড়ি, যেতে হয় তাঁর ছয় বছরের ছেলেকে নিয়ে। এরই মধ্যে ছেলের চোখে চশমাও লেগেছে। চিকিৎসকদের একটাই কথা, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে।

বাড়িতে একসঙ্গে খাবার না খাওয়ার প্রবণতা কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই বেশি। তাদের একটি বড় অংশই দিনের বেলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকার কারণে বাইরে খায়। রাতের খাবার একসঙ্গে খাওয়ার আগ্রহও তাদের খুব একটা দেখা যায় না। অনেকেই প্লেট নিয়ে টিভি বা ল্যাপটপের সামনে চলে যায়। আর টেবিলে বসলেও অন্য হাতে মোবাইল টিপতে থাকে। বাসার খাবার পছন্দ না হলে অনলাইনে পছন্দের খাবার অর্ডার করে নিজের রুমে বসে খায়। এতে করে শিশুরা পরিবার থেকে আলাদা হতে শুরু করে। অজান্তেই মা–বাবার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে।

সন্তানদের ঠিকঠাক পুষ্টি দিতেও একসঙ্গে বসে খাওয়া জরুরি
ছবি : সুমন ইউসুফ

এ তো গেল বাংলাদেশের এখনকার গড়পড়তা দৃশ্য। হাজার হাজার মাইল দূরের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থা আরও খারাপ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন নাগরিকেরা প্রতি পাঁচ বেলার মধ্যে এক বেলার খাবার গাড়িতে খায়। প্রতি চারজনের একজন প্রতিদিন এক বেলা ফাস্ট ফুড খায়। আর বেশির ভাগ পরিবার পাঁচ দিনের মধ্যে শুধু এক বেলা সবাই একসঙ্গে খেতে পারেন। এর মানে তাঁরা প্রিয়জনের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সময় কাটানোর সুযোগ হারিয়ে ফেলছেন। একসঙ্গে না খাওয়ার ফলে শরীর ও মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সবাই শুধু ছুটে চলছে। কারও যেন সময় নেই দুদণ্ড বসার। এ কারণে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে থাকছেন কমবেশি সবাই। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এভাবে মানসিক চাপে থাকলে মানুষের হৃদ্‌রোগ ও স্ট্রোক হতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণাও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। তাদের মতে, এ চাপ কমানোর একটি পন্থা পরিবারের সবাই একটা নির্দিষ্ট সময় একসঙ্গে কাটানো। হতে পারে সেটা একসঙ্গে বসে খাওয়া।

পরিবারের সবাই  একসঙ্গে খাবার খেলে শিশুরা সব ধরনের খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়। অন্যদের দেখে তার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে।
ইশরাত জাহান, পুষ্টিবিদ, সাজেদা ফাউন্ডেশন

দেশজুড়ে এক হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর এ গবেষণা চালায় তারা। অংশগ্রহণকারীদের ৮৪ শতাংশ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে যদি তাঁরা এক বেলা খাবার খেতে পারতেন! আর অভিভাবকদের প্রায় সবাই বলেছেন, নিয়মিত খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসার কারণে তাঁদের সবার দেখা হয়, কথা হয়। এতে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ওয়াসিফা তাসনিম বলেন, ‘যৌথ পরিবারে খাবার টেবিলের আড্ডায় কমে যেত দৈনন্দিন জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, মানসিক চাপ। আজকের শহুরে জীবনের একক পরিবারে যা কম দেখা যায়। এতে সমাজ আর পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছেদ আর বিচ্যুতি শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে মানসিক ও শারীরিক জটিলতা।’

বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট জানিয়েছে, যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার সঙ্গে নিয়মিত খাবার খায় না, স্কুলে তারা বেশি ভুল করে।

২০১৪ সালের মে মাসে বুলগেরিয়ায় স্থূলতা সম্পর্কিত ইউরোপীয় কংগ্রেসে একটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, যে শিশুরা সপ্তাহে অন্তত দুবারও তাদের মা–বাবার সঙ্গে রাতের খাবার খায় না, তাদের ওজন; যারা খায় তাদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। বিপরীতে, যে শিশুরা সপ্তাহে পাঁচ বা তার বেশি দিন পরিবারের সঙ্গে খায়, তাদের মাদকের প্রতি আসক্তি কম তৈরি হয়। একই সঙ্গে তারা স্বাস্থ্যকর খাবার খায়, পড়াশোনায় ভালো করে, ঘনিষ্ঠ হয় মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্ক।

মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক মিশেল পোল্যান তাঁর কোকড বইয়ে লিখেছেন, বাড়ির বাইরে খাবার খাওয়ার দুটি খারাপ দিক আছে। প্রথমত এসব খাবার অস্বাস্থ্যকর। আর অপরটি হলো একাকিত্ব। খাবার টেবিল মূলত সবাইকে একত্র করার জায়গা। সবাই মিলে খাবার খাওয়ার মানে হলো কথা বলার সুযোগ। যেখানে সবাই তাদের কাজকে এক পাশে রেখে একটি ভালো সময় কাটায়।

সবাইকে একসঙ্গে খাওয়ার টেবিলে পাওয়া সব সময় সহজে হয়ে ওঠে না। অন্যান্য ভালো অভ্যাসের মতো এটাকেও তাই পরিবারের বড়দের উদ্যোগে চর্চা করতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে এটি অভ্যাসে পরিণত হবে। অনেক সময় পরিবারের কারও মন খারাপ থাকতে পারে, খাবার টেবিলে বসলে সেটা অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখা কঠিন। বাকিরা যখন সেটা বুঝতে পারবে, তার সঙ্গে কথা বলে, তার পাশে থেকে পরামর্শ দিয়ে মন খারাপভাব   দিতে হবে।

আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণাও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। তাদের মতে, এ চাপ কমানোর একটি পন্থা পরিবারের সবাই একটা নির্দিষ্ট সময় একসঙ্গে কাটানো। হতে পারে সেটা একসঙ্গে বসে খাওয়া।

সন্তানদের ঠিকঠাক পুষ্টি দিতেও একসঙ্গে বসে খাওয়া জরুরি। সাজেদা ফাউন্ডেশনের পুষ্টিবিদ ইশরাত জাহান বলেন, ‘পরিবারের সবাই  একসঙ্গে খাবার খেলে শিশুরা সব ধরনের খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়। অন্যদের দেখে তার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। সব ধরনের পুষ্টি তার শরীরে যায়। একসঙ্গে বসে খেলে শিশুদের মধ্যে শেয়ার করার মানসিকতাও গড়ে ওঠে। অথচ একা খাবার খেলে তার পছন্দই বেশি প্রাধান্য পায়। একপর্যায়ে মুখরোচক ক্ষতিকর খাবারগুলোর প্রতি তার আসক্তি তৈরি হয়।’

ব্যস্ততা আমাদের শহুরে জীবনে হয়তো তিন বেলা পরিবারের সঙ্গে খাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারে না। তবে সকালে নাশতার টেবিলে বা দিন শেষে রাতের বেলা একসঙ্গে বসা কি খুব কঠিন? মুঠোফোনে সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করতে গিয়ে পরিবারের ভেতরেই অসামাজিক হয়ে পড়া কতটা যৌক্তিক? পরিবারের অভিভাবক হিসেবে ২৪ ঘণ্টায় একবার সবাইকে খাবার টেবিলে জড়ো করার দায়িত্বটা না হয় আপনিই নিলেন। এতে কাছে থাকার আনন্দ আরও বাড়বে। সন্তানেরা বেড়ে উঠতে পারবে স্বাস্থ্যকর ও সুস্থ মানুষ হিসেবে।