সন্তানের কাছে ভুল করলে কী করব?

নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুঃখিত বলার মধ্যে ছোট হওয়ার কিছু নেই। দুঃখ প্রকাশ করলে সে বরং আপনাকে নায়ক মনে করবে। মডেল: পানশী ও পাভেল
ছবি: সুমন ইউসুফ

প্রতিদিন কোচিং শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি ফেরে লাবণ্য। একদিন হঠাৎ বাড়ি ফিরতে এক ঘণ্টা দেরি হয়ে যায়। আর এ জন্য তাকে দুকথা শুনিয়ে দেন বাবা-মা। নিজের সমর্থনে কিছু বলার সুযোগও পায় না লাবণ্য। কিছুক্ষণ পর খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, সামনে পরীক্ষা বলে বিষয় শিক্ষক অতিরিক্ত ক্লাস নিয়েছেন। নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও সন্তানের কাছে তা স্বীকার করার প্রয়োজনীয়তা তার বাবা-মা বোধ করেন না।

সন্তানদের ভুলে বাবা-মা শাসন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সন্তান নিজেকে শুধরে নেবে, পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবে, এটাই সাধারণত নিয়ম। কিন্তু ভুল কি শুধু সন্তানই করে, বাবা-মা করেন না? তখন? সেই ভুল শুধরে সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করবেন কীভাবে?

সন্তানকে শাসন করতে গিয়ে কোনো ভুল করলে সেটা স্বীকার করে নিন। মডেল: পানশী ও পাভেল
ছবি: সুমন ইউসুফ

ক্ষমা চাওয়াকে আমাদের এখানে খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। নিজের ভুল বুঝতে পেরে বা ভুল থেকে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়ার নজির খুবই কম। আর সেই ক্ষমা যদি চাইতে হয় বয়সে ছোট কারও কাছে, তবে তো প্রশ্নই ওঠে না। এ অঞ্চলের সমাজব্যবস্থায় বয়সে ছোট কারও কাছে ক্ষমা চাওয়া যেন নিষিদ্ধ কাজ। অনেকে আবার ভুল বুঝতে পারলেও স্বীকার করতে এবং ক্ষমা চাইতে দ্বিধা বোধ করেন, হীনম্মন্যতায় ভোগেন। সম্মানহানির ভয়ে মুখ ফুটে ক্ষমা চাইতে পারেন না। আর সম্পর্কটা যখন হয় সন্তানের সঙ্গে পিতা–মাতার, তখন ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি হয়ে ওঠে আরও জটিল। কিন্তু এই ছোট্ট বাধাটি সহজেই ডিঙিয়ে ফেলতে পারলে সন্তানের কাছে আপনি হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃত নায়ক।

সন্তানদের বয়স যত বাড়তে থাকে, মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ততই শীতল হতে শুরু করে। শিশু বয়সে সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার যে আত্মার সম্পর্ক থাকে, বয়ঃসন্ধিকালে সেটা অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়। সম্পর্ক ফিকে হয়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে দুই পক্ষের মধ্যে সঠিক যোগাযোগের অভাব। সন্তানের ভুলত্রুটি মা-বাবা চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিলেও মা–বাবার ভুলত্রুটি কিন্তু জবাবদিহির বাইরেই থেকে যায়। সন্তানের মনে জমতে থাকা অভিমান ধীরে ধীরে বিকশিত হয়, ভুল না শোধরানো থেকে ক্ষমা না চাওয়া, যোগাযোগ রক্ষা না করতে পারার প্রভাব সম্পর্কে পড়তে থাকে। ফলে কমতে থাকে সম্পর্কের উষ্ণতা। তাই নিজের ভুল হলে সন্তানের কাছে স্বীকার করাটা জরুরি। প্রথম দিকে সরাসরি বলতে না পারলে ধাপে ধাপে এগোতে পারেন।

সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক হোক সহজ ও স্বাভাবিক। মডেল: পানশী ও পাভেল
ছবি: সুমন ইউসুফ

ভুল উপলব্ধি করা

ক্ষমা চাওয়ার প্রথম ধাপ হলো বুঝতে পারা। উপলব্ধি করতে পারা যে অভিভাবক হিসেবে আমার একটা ভুল হয়েছে। ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে কেউ নয়, মানুষমাত্রই ভুল করে। ঘটনাচক্রে সে ভুলের প্রভাব পড়তে পারে আপনার সন্তানের ওপর। তবে সেই ভুলের প্রভাব একদিনে পড়ে না। বরং ঠিক সময়ে ঠিক উদ্যোগ নিলে সেই ভুল প্রভাব কাটানো যায় সহজে। তাই নিজের ভুল বুঝতে পেরে শোধরানোর জন্য দ্রুত কাজ শুরু করা জরুরি। ভুল শোধরানো কিংবা ক্ষমা চাওয়ার প্রথম ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নিজের ভেতরে উপলব্ধি আনা।

ভুল স্বীকার মানে হেরে যাওয়া নয়

এ প্রসঙ্গে গত ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ‘মনের বন্ধু’র সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর নাদিয়া নাসরিনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘বাবা–মায়েরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেও সচরাচর সন্তানের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চান না। বরং সন্তানের কাছে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে হীনম্মন্যতায় ভোগেন। আমরা সব সময়ই বলি, দাম্পত্য জীবন হোক আর পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক হোক কিংবা বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের, যোগাযোগের জায়গাটা যাতে ঠিক থাকে। আমি যা উপলব্ধি করছি, তা যেন সরাসরি বলতে পারি। অভিভাবকদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঠিক একই রকম।’

সন্তানের কাছে ভুল স্বীকার করে মা-বাবাও হতে পারেন নির্ভার। মডেল: পানশী ও পাভেল
ছবি: সুমন ইউসুফ

অনেকেই মনে করেন, সন্তানের কাছে ভুল স্বীকার করা মানে সন্তানের কাছে নতি স্বীকার। কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা এমন নয়। শিশুদের কাছে ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না, বরং তারা ঠিক-বেঠিকের পার্থক্য শিখতে শুরু করে। ভুল করলে যে ক্ষমা চাওয়া উচিত, সেটিও বুঝতে শেখে। বয়স কোনো বিষয় নয়, বরং ভুল করলে ক্ষমা চাওয়া উচিত—তার মধ্যে এমন বোধ জন্ম নেয়। শাসন করার ফলে মনের ভেতর যে অভিমান জমা হয়েছিল, দ্রুত তা মুছে যায়। আর ভুল স্বীকার করে সন্তানের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করে মা-বাবাও হন নির্ভার।

শিক্ষা হোক ছোটবেলা থেকে

শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যখন দেখবে আশপাশের মানুষজন তার সঙ্গে নিজের মনের কথা সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করছে, ভুল করলে স্বীকার করছে, তা থেকে শিশুও শিখতে পারবে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অভিভাবকদের মধ্যে ভুল স্বীকার না করার অভ্যাস তার পূর্ববর্তী প্রজন্ম থেকে এসেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভুল শিক্ষা চলে আসছে। সেই ভুল শুধরে ছোটবেলা থেকেই সঠিক শিক্ষা দেওয়া শুরু করুন। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই ভুল শোধরানোর শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই শিশুদের দেওয়া হয় না। ফলে পরবর্তী জীবনে ভুল করে অনুতপ্ত না হওয়া কিংবা না শোধরানোর প্রবণতা দেখা যায়। শিশুদের ভবিষ্যৎ জীবনেও যা প্রভাব ফেলে।

কারণ বুঝিয়ে বলা

সন্তানদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার থেকেও বেশি জরুরি ভুল সংশোধন করা। দুই পক্ষের কী ভুল ছিল, তা আলোচনা করা। প্রথম ঘটনার কথাই ধরা যাক, কোচিং থেকে দেরিতে আসার কারণে শাসন করাটা অস্বাভাবিক নয়, তবে দিন শেষে নিজের অবস্থান সন্তানের কাছে পরিষ্কার করা জরুরি। তার দেরির কারণে যে অভিভাবক হিসেবে দুশ্চিন্তা হয়, সেটি সন্তানকে বোঝানো। সাইকো সোশ্যাল কাউন্সিলর নাদিয়া নাসরিনের মতে, ক্ষমা চাওয়ার সময় কারণ বুঝিয়ে না বললে অপর পক্ষও বুঝতে পারবে না, কেন হঠাৎ তার কাছে ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে। সম্পর্ক জোড়া লাগার পরিবর্তে তখন সেটি একটি বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

আরও পড়ুন

ভবিষ্যতে একই ভুল না করা

‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না,’ কথাটি ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হলেও জীবনের অন্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভুল শোধরানো এবং ক্ষমা চাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ শুরু হয় ক্ষমা চাওয়ার ঠিক পরমুহূর্ত থেকেই। ঠিক যে কারণে সন্তানের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, ভুল স্বীকার করেছেন, সেই একই ভুল যাতে আবার না হয়। সন্তানকে দেওয়া কথা যাতে আপনি রাখতে পারেন। নইলে ক্ষমা চাওয়া, ভুল স্বীকার—সবই অর্থহীন হয়ে পড়বে। বাবা-মায়ের ওপর থেকে সন্তানের বিশ্বাস আস্তে আস্তে কমতে থাকবে।

আরও পড়ুন

মানুষ হিসেবে ভুল স্বীকার করা কিংবা ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস আমাদের নেই বললেই চলে। যেকোনো বয়স থেকেই শুরু হতে পারে সেই অভ্যাস। নাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘শিশুরা অভিভাবকের কাছ থেকে এই অভ্যাস জেনে ও দেখে বড় হলে পরবর্তী জীবনে তা আদর্শ হিসেবে ধারণ করবে। তার মানে এই নয়, সন্তান একটু বড় হয়ে গেলে এই অভ্যাস শুরু করা যাবে না। ভালো অভ্যাস যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে শুরু করা যায়। তবে সন্তানেরা বুঝতে শুরু করলে দেখা যায়, হুট করে ক্ষমা চাইলে উল্টো সে ঘাবড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বুঝিয়ে বলে নতুন করে শুরু করা যেতে পারে। তবে আশার কথা, এখনকার বাবা-মা আগের থেকে বেশ সচেতন। অনেক নতুন মা-বাবা ট্রেনিং নিচ্ছেন, সন্তানের ভালোর জন্য নিজেকে ভালোভাবে তৈরি করছেন।’

মান-অভিমান, দুঃখ-কষ্ট, ভুলত্রুটি মিলিয়েই সম্পর্ক। প্রতিটি মিষ্টি সম্পর্কের পেছনেই আছে ছোট ছোট এমন সব গল্প। কিন্তু সেই আড়ালের গল্প যাতে প্রভাব না ফেলে মা-বাবা আর সন্তানের জীবনে, সেটা লক্ষ রাখাই সবচেয়ে জরুরি।

তথ্য সুত্র: নিউজ১৮