দাদা–দাদি, নানা–নানি ছাড়া বড় হওয়া শিশুর ওপর কী মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, জানুন এই গবেষণায়

কলকাতার জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ গেয়েছিল, ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে ড্রইংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী’। তবে পৃথিবীটা এখন ড্রইংরুমের বোকা বাক্সের চেয়ে আরও ছোট বাক্সে ঢুকে পড়েছে। মুঠোফোনে সেই ছোট্ট পৃথিবীতে খুব কমই ঠাঁই হয় দাদা–দাদি ও নানা–নানিদের। যৌথ পরিবার এখন খুঁজে পাওয়া দায়। সন্তান পালনের চ্যালেঞ্জ যে কত কঠিন, তা শহুরে চাকরিজীবী মা–মাত্রই জানেন। সারা বিশ্বেই যখন এমন বাস্তবতা, তখন ফিনল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব তুর্কুর নতুন গবেষণা জানাচ্ছে, কেবল একজন গ্রান্ডপ্যারেন্ট অর্থাৎ দাদা–দাদি, নানা–নানি শিশুর জীবনে রাখে খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর শক্তিশালী ভূমিকা। কী সেটা? চলুন, জেনে নেওয়া যাক।

যেসব শিশু তাদের নানা বা নানি, দাদা বা দাদির সঙ্গে বড় হয়েছে, তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে তুলনামূলক ইতিবাচকভাবেছবি: প্রথম আলো

এই গবেষণায় ২০০৭ সাল থেকে ১১–১৬ বছর বয়সী ১ হাজার ৫৬৬ ইংরেজ শিশুর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। ওই সব শিশু পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে কী ধরনের সমস্যায় পড়েছে, কীভাবে তার মোকাবিলা করেছে, কীভাবে জীবনযাপন করেছে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে নিয়ে এই গবেষণায় বিশ্লেষণ করে ফলাফল নির্ধারণ করা হয়। এসব শিশুকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম দলে তারা ছিল, যারা বেড়ে ওঠার সময় অন্তত একজন গ্রান্ডপ্যারেন্টকে (দাদা–দাদি বা নানা–নানি—এই চারজনের যেকোনো একজন) পাশে পেয়েছে। দ্বিতীয় দলে ছিল তারা, যারা কাউকেই পায়নি।

গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু তাদের নানা বা নানি, দাদা বা দাদির সঙ্গে বড় হয়েছে, তাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে তুলনামূলক ইতিবাচকভাবে। তাদের সমস্যা সমাধানের দক্ষতাও অপর দলভুক্ত শিশুদের চেয়ে ভালো। এমনকি তাদের অসুখে ভোগার হারও ছিল কম। এসব শিশু বড় হয়ে হতাশায়ও ভুগেছে কম। এদের পরিবারিক বন্ধনও হয়েছে মজবুত। দেখা গেছে, বয়স ১৮ হয়ে যাওয়ার পরও তারা খুব কমই পরিবার ছেড়ে গেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব শিশু তাদের গ্রান্ডপ্যারেন্টের সঙ্গে থেকেছে, তাদের ওপর ‘টক্সিক প্যারেন্টিং’ ও মা–বাবার নেতিবাচক সম্পর্কের প্রভাব কম। সেসব তাদের মানসিক বিকাশে খুব কমই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব শিশু প্রযুক্তির চেয়ে মানুষে–মানুষে যোগাযোগকেই অধিক গুরুত্ব দেয়। এসব শিশুর মধ্যে পরবর্তী সময়ে নেশাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাও কম।

এই গবেষক দলের প্রধান স্যামুলি হেলে মার্কিন সংবাদমাধ্যম হাফপোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, দাদা বা দাদি, নানা বা নানি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। গ্রান্ডপ্যারেন্টের সাহচর্য পাওয়া শিশুরা খুব কমই চাইল্ডহুড ট্রমায় পড়ে। আর তাদের মনের ওপর এই ইতিবাচক প্রভাব সরাসরি শরীরেও পড়ে। এসব শিশুর রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অন্যদের তুলনায় ভালো। পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হাঁপানি এমনকি ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কম থাকে তাদের।

এর কারণও জানিয়েছেন গবেষক স্যামুলি হেলে। দাদা–দাদি, নানা–নানিরা যত দিনে মা–বাবা থেকে এই পর্যায়ে যান, তত দিনে তাঁদের বেশির ভাগই নিজেদের শুধরে নেন। বয়স আর অভিজ্ঞতায় তাঁরা পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠেন। মা–বাবা হিসেবে ‘টক্সিক’ হওয়ার ইতিহাস থাকলেও দাদা–দাদি, নানা–নানি হিসেবে তাঁরা বেশ ভালো ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন।

দাদা–দাদি, নানা–নানি কীভাবে এই ভূমিকা রাখেন?

১. শিশুর মা–বাবা অনেক ক্ষেত্রেই পেশাগত জীবন ও নানা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এদিকে গ্রান্ডপ্যারেন্টরা বেশির ভাগই অবসরপ্রাপ্ত। ফলে তাঁরা নিজেদের সময়, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সবটুকু নাতি–নাতনিদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন।

২. বয়সী সঙ্গীরা শিশুকে মা–বাবার টক্সিক প্যারেন্টিং, পারিবারিক কলহ, বিচ্ছেদের নেতিবাচক প্রভাব ও চাইল্ডহুড ট্রমা থেকে রক্ষা করেন। অসুখে, অর্থনৈতিক সংকটে, পারিবারিক বা যেকোনো বিপর্যয়ে ঢাল হয়ে পাশে থাকেন গ্রান্ডপ্যারেন্টরা।

৩. শিশুর বেড়ে ওঠায় শৃঙ্খলা আনতে সাহায্য করেন গ্রান্ডপ্যারেন্টরা। যেমন প্রতিদিন স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, একই সময়ে গোসল করানো, বিকেলে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, রাতে গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে শিশুকে শৃঙ্খলিত জীবনে অভ্যস্ত করেন তাঁরা।

৪. শিশুকে একটা স্থিতিশীল জীবন দিতে সাহায্য করেন। গ্রান্ডপ্যারেন্ট পাশে থাকলে শিশুরা খুব কমই অনিশ্চয়তায় ভোগে। আর আত্মবিশ্বাসী হয়ে গড়ে ওঠে। গ্রান্ডপ্যারেন্টরা গল্প শুনিয়ে শিশুর কল্পনার দুয়ার খুলে দেন। শিশুর শৈশব রাঙিয়ে দেন ছোট ছোট আনন্দের গল্প আর স্মৃতিতে।

৫. নানা–নানি, দাদা–দাদিরা তাঁদের ছোটবেলা, দেশ, রাজনীতি, পরিবার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও জীবনের নানা অভিজ্ঞতার গল্প নাতি-নাতনিদের সঙ্গে ভাগ করে নেন। কখনো বিপদে বা সমস্যায় পড়লে তাঁরা কীভাবে সমাধান করেছেন, সেসব অভিজ্ঞতার গল্প করেন। ফলে কোনো সমস্যায় পড়লে শিশুরা সহজেই হতাশ হয়ে দিশাহারা হয়ে পড়ে না। বরং সমাধান খোঁজে।

সর্বোপরি একটা মজবুত সম্পর্কের শক্তি অনুধাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন নানা-নানি, দাদা-দাদিরা। একই সঙ্গে মানসিকভাবে ভালো থাকা, একাকিত্ব ঘোচানো, শারীরিকভাবে তৎপর ও ইতিবাচক থাকতেও গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন নানা–নানি, দাদা–দাদিরা।

সূত্র: হাফপোস্ট

আরও পড়ুন