শিশুর স্ক্রিন টাইম নিয়ে আপনার যা জানা জরুরি
মা শিশুকে খাওয়াচ্ছেন, শিশুর হাতে একটি মুঠোফোন, তাতে চলছে হট্টগোলে পরিপূর্ণ কোনো ভিডিও। শিশু মায়ের দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। একবার খেয়াল করে দেখছে–ও না তার মুখে কী দেওয়া হচ্ছে। সে ফোনেই বুঁদ। এমন দৃশ্য এখন ঘরে ঘরে। আমাদের জীবনের সঙ্গে প্রযুক্তি কীভাবে মিশে আছে, এটি তার একটি উদাহরণমাত্র। আমরা চারপাশের পৃথিবীকে কীভাবে দেখছি, পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে মিশছি, এর সবকিছুতেই আছে প্রযুক্তির প্রভাব। প্রশ্ন হলো, এসব বিষয় আপনার শিশুর বিকাশকে কীভাবে প্রভাবিত করে?
মানুষের বিকাশ মূলত একটি সামাজিক বিষয়। শৈশব থেকেই আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশের অংশ হয়ে উঠতে থাকি। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখতে থাকি। বিশেষ করে অপরিচিত পরিস্থিতি ও সংস্কৃতিতে আমরা বেশি শিখি।
প্রাপ্তবয়স্করা যখন শিশুদের সঙ্গে মেশেন, তাঁরা নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি শিশুদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। বড়রা চারপাশের বৈচিত্র্য, জটিলতা ও সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করে সবকিছু বুঝতে চেষ্টা করেন।
শিশুরা বড়দের কাছ থেকে শিখতে পারে। অন্যদিকে বড়রাও শেখেন, পৃথিবীকে কীভাবে শিশুদের চোখে দেখতে হয়। আমাদের মনোযোগ যদি স্ক্রিনের দিকেই থাকে, তাহলে কীভাবে আমরা চারপাশের পরিবেশকে দেখতে ও বুঝতে পারব?
শিশুদের কাছে যোগাযোগ কোনো বিমূর্ত কিংবা তাত্ত্বিক বিষয় নয়। বড়দের সঙ্গে কাটানো ছোট ছোট সময়েই তারা যোগাযোগ শেখে। হোক সেটা স্কুলে যাওয়ার পথে একটি শামুককে চলতে দেখা কিংবা বাড়িতে আপনজনদের সঙ্গে বই পড়া। এভাবেই তারা ‘মানুষ’ হয়ে ওঠে।
বড়দের সঙ্গে ছোটদের কাটানো মুহূর্তগুলোকে বিশেষ করে তোলে আমাদের আচরণ। যেমন চোখের দৃষ্টি, কণ্ঠস্বর, ভাষা, হাত–পায়ের নড়াচড়া ইত্যাদি। প্রতিটি বিষয়ই জীবনের শুরুর বছরগুলোয় শিশুর শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আপনার শিশু আর আপনি কতক্ষণ ধরে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কখন দৃষ্টি সরিয়ে নেন, কীভাবে একজনের পর আরেকজন কথা বলেন—এসব দেখেই শিশু যোগাযোগের প্যাটার্ন বুঝতে শেখে। এই প্যাটার্ন দেখেই শিশু অন্যদের সঙ্গে মিশতে শেখে। দলবদ্ধভাবে কাজ করতে শেখে। শিশুদের সঙ্গে বড়দের পারস্পরিক এই মিথস্ক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই।
‘পোস্ট ডিজিটাল মানুষ’ হয়ে ওঠা
স্মার্ট ডিভাইস ও স্ট্রিমিং অ্যাপগুলো এখন দৈনন্দিন পারিবারিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। আজকাল দুই থেকে পাঁচ বছরের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশু প্রতিদিন এক ঘণ্টার বেশি সময় স্ক্রিনে চোখ রাখে। খুব ছোটবেলায় শিশুদের স্ক্রিনে অভ্যস্ত হওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
গত ২০ বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, ডিজিটাল প্রযুক্তি শিশুদের দৈনন্দিন কাজ—যেমন খেলা, মনোযোগ রাখা, কিছু মনে রাখা, এমনকি ঘুমানো—সবকিছুই বদলে দিচ্ছে।
প্রতিদিন বেশি সময় ধরে স্ক্রিনে চোখ রাখলে শিশুরা কিছু কাজ করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ে। যেমন পড়া বা যেকোনো কাজ শেষ করা, পরিবারের মধ্যে সমস্যা হলে শান্ত থাকা ইত্যাদি। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে স্ক্রিন ব্যবহারের ফলে তাদের ঘুমের মান কমে যায়।
এমনকি ব্যাকগ্রাউন্ডে টিভি চলতে থাকলেও শিশুদের খেলার মান কমে যায়। তাদের মনোযোগ নষ্ট হয় এবং তারা খুব অল্প সময় ধরে খেলে।
প্রযুক্তি মানেই খারাপ নয়
তবে সব পরিবর্তন খারাপ নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, স্মার্ট প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্কে পরিবর্তন আনে। তবে কিছু পরিবর্তন উপকারী হতে পারে। ভালো মানের কার্টুন, শিক্ষামূলক অ্যাপ বা মানসম্মত ভিডিও শিশুদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। ভাষা শেখার ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
এতে প্রশ্ন আসে, আমরা কি ধীরে ধীরে প্রযুক্তি নির্ভর নতুন ধরনের মানুষে পরিণত হচ্ছি? শিশুরা যখন স্মার্টফোনে ইউটিউব দেখে বা অ্যাপ ব্যবহার করে, তারা কি সত্যিই আরও বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে?
প্রযুক্তি শিশুদের কিছু ক্ষেত্রে বেশি দক্ষ করে তুলতে পারে। অন্যদিকে তাদের মনোযোগ, খেলা ও ঘুমের ক্ষতিও করতে পারে। স্ক্রিন ব্যবহারের এই অভ্যাস শিশু ও মা–বাবার সম্পর্ককে কীভাবে প্রভাবিত করে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন।
সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস ল্যাবের গবেষণা দল বর্তমানে খুঁজে দেখছে শিশুরা প্রযুক্তিকে কীভাবে বোঝে এবং ডিজিটাল অভ্যাস তাদের স্কুল ও পরিবারের সম্পর্কগুলোকে কীভাবে বদলে দিচ্ছে।
কোনো জাদুকরি সমাধান নেই
ছোটদের জন্য বড়দের দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হলো মনোযোগ। ১০০ বছর আগে ইতালীয় চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্তেসরি এমনটিই বলেছিলেন। তাঁর মতে, শিশু যেভাবে পৃথিবীকে আবিষ্কার করে, সেই প্রক্রিয়ায় বড়রা মনোযোগ দিলে এবং তাতে অংশ নিলে সেটিই শিশুর জন্য সবচেয়ে মূল্যবান।
বড়রা ও শিশুরা অন্য কিছুর দিকে মনোযোগ দিলে একসঙ্গে শেখা বা নতুন কিছু আবিষ্কারের সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
শিশুর সঙ্গে থাকার সময় তার প্রতি মনোযোগ খুব জরুরি। কারণ, এমন সময়েই শিশুরা বুঝতে শেখে, তারা কী করতে পারে, তারা কেমন প্রভাব ফেলতে পারে এবং কীভাবে অন্যদের সঙ্গে যুক্ত বা বিচ্ছিন্ন হতে হয়।
যা করতে পারেন
পশ্চিমা দেশের অনেক মা–বাবা এখন শিশুদের স্ক্রিন টাইম নিয়ে চিন্তিত। বেশির ভাগ পরিবারই শিশুর জন্য ধরাবাঁধা নিয়ম তৈরি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কোন কোন সময় শিশুকে প্রযুক্তির দুনিয়ায় ছেড়ে দেওয়া যায়, আর কোন সময় পুরোপুরি স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা উচিত, তা বুঝে নিতে হবে নিজেদের মতো করে। কিছু বিষয় মনে রাখুন—
দিনের যে সময়গুলোয় পুরো পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে থাকেন, সেসব সময় শিশুকে স্ক্রিনমুক্ত রাখুন। এসব সাধারণ মুহূর্ত হলেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ঘুমানোর আগে বই পড়া, যানবাহনে চড়ে যেতে যেতে গল্প বানানো, বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাস্তায় পড়ে থাকা ফুল কুড়ানো, এসবই শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে।
স্ক্রিন-ফ্রি মুহূর্ত যতটা পারেন ধরে রাখুন। যখন খুব ক্লান্ত থাকেন বা কোনোভাবেই শিশুকে সময় দিতে পারেন না, তখন স্ক্রিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
সবাইকে একই নিয়মের আওতায় আনা সম্ভব না-ও হতে পারে। নিজের পরিবারের জন্য যা মানানসই, তা-ই অনুসরণ করুন।
শেষ কথা
আগামী কয়েক বছরে হয়তো দেখা যাবে, অন্যদের সঙ্গে ধীরে ধীরে শিখে এগিয়ে যাওয়ার পুরোনো অভ্যাস অনেকটাই বদলে গেছে। প্রযুক্তির ভালো–মন্দ দুটি দিকই আছে। মোটকথা, শিশু কীভাবে স্ক্রিন দেখে, খেলে বা ডিজিটাল পণ্য ব্যবহার করে, সেদিকে নজর দেওয়া খুব প্রয়োজন।
সূত্র: দ্য কনভারসেশন