যে শাড়ির হাটে ৪৫০ টাকায় মিলবে দেশীয় ব্র্যান্ডের শাড়ি
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। এক ফ্যাশনসচেতন বন্ধুকে দেখতাম, নিত্যনতুন শাড়ি পরে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেন। শাড়িগুলো খুব যে দামি, তা কিন্তু নয়; তবে রং আর বুননের কারণে শাড়িগুলোতে ঠিক চোখ আটকে যেত। একদিন জানতে চাইলাম, কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন এসব শাড়ি। উত্তর এল, গাছতলা থেকে। গাছতলা! সে আবার কোন জায়গা?
বান্ধবী জানালেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। সেখানে গাছতলায় বসে শাড়ির হাট। সেই বছরই পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করতে জাহাঙ্গীরনগর যাওয়া হলে খুঁজে বের করি সেই শাড়ির হাট। তবে সেবার গাছতলায় নয়, ভ্যানে করে বিক্রি হচ্ছিল চোখজুড়ানো তাঁতের শাড়ি।
বটতলায় ভর্তা–ভাজি দিয়ে ভরপেট খাওয়া আর ভ্যানে করে ঘুরতে ঘুরতে সবুজের মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকায় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস অনেকেরই পছন্দের জায়গা। এখানকার শাড়ির জনপ্রিয়তাও কিন্তু কম নয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা এখানে ঘুরতে আসা লোকজনই নন, এই শাড়ি কিনতে গাজীপুর, ঢাকা ও সাভারের লোকজনও আসেন। শাড়ি নিয়ে কাজ করেন, এমন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে পরিচিত এক জায়গা এই শাড়ির হাট। সেই হাট দেখতেই একদিন বেরিয়ে পড়া গেল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটের উত্তর দিকে মামা মার্কেটে যখন পৌঁছালাম, তখন দুপুর। শাড়ির ভ্যানগুলো এখন প্রান্তিক গেটের মামা মার্কেটে বসছে (তবে বিক্রেতারা বললেন, এই স্থানও যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে)। সবে ভ্যানে পাটে পাটে শাড়িগুলো সাজিয়ে রাখছেন দোকানিরা। হালকা রঙের শাড়িতে চিকন পাড়ের সমাহারই বেশি। তবে কোনোটায় ব্লকের কাজ আবার কোনো শাড়িতে হাতের কাজের নকশাও আছে। আরও ছিল প্লাস পাড়, ডিজিটাল প্রিন্ট ও এক রঙের থানের শাড়ি। নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ নকশার শাড়িগুলো সঙ্গে থাকা আলোকচিত্রীর মন কেড়ে নিল। ছবি তোলার ফাঁকে ফাঁকেই শাড়ি কিনলেন। দোকানিরাও বেশ আন্তরিক। বলছিলেন, এখানে একবার এলে কেউ খালি হাতে ফেরেন না।
প্রায় ৯ বছর ধরে এখানে শাড়ি বিক্রি করছেন মাহমুদুল হাসান। বলছিলেন, আগে শুধু শিক্ষার্থীরা শাড়ি কিনতেন। এখন দূরদূরান্ত থেকেও অনেকে আসেন। বিশেষ করে অনলাইনে বেচাকেনার জন্য অনেকেই এখান থেকে শাড়ি নিয়ে যান। তারপর মনের মতো নকশা করেন। ১০ বছর এখানে শাড়ির ব্যবসা করেছেন হীরু মল্লিক। সাভারেই শাড়ি আনতে গিয়ে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হলে ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর ছেলে মানিকগঞ্জ কলেজের ছাত্র মানিক মল্লিক। ৪ বছর ধরে পড়াশোনার পাশাপাশি একা হাতেই ব্যবসা সামলাচ্ছেন। আগে তাঁদের বাড়ির তাঁতেই তৈরি হতো শাড়ি। এখন মানিকগঞ্জ থেকে আনেন।
জানা গেল, এই হাটের বেশির ভাগ শাড়িই একসময় মানিকগঞ্জ থেকে আসত। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বড়াইদ ইউনিয়নের সাভার গ্রামে তাঁতপল্লি থেকে এখনো শাড়ি আসে, তবে সংখ্যায় কম। শাড়ির চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দুটিই বেড়ে যাওয়ায় এখন বেশির ভাগ শাড়ি টাঙ্গাইল থেকে আনেন বিক্রেতারা। আর গুণগত মানেও মানিকগঞ্জের চেয়ে টাঙ্গাইলের শাড়ি ভালো, মনে করেন তাঁরা।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পারিবারিকভাবে অনেকেরই তাঁত ছিল। যেখানে তাঁদের বাবা-দাদারাই বুনতেন শাড়ি। তবে এখন শাড়ি কিনে এনে বিক্রি করা হয়। কারণ, এখন পাওয়ার লুমেই কাজ বেশি হয়। ব্যয়বহুল হওয়ায় সবার বাড়িতে পাওয়ার লুম বসানো সম্ভব নয়। এ জন্য টাঙ্গাইল থেকে শাড়ি কিনে বিক্রি করাটাই তাঁদের কাছে সহজ বলে মনে হয়।
কীভাবে এখানে শাড়ির হাট শুরু হয়েছিল, জানতে চাইলে দোকানিরা জানান, টাঙ্গাইলের এক তাঁতির (নামটা সঠিক কেউ বলতে পারলেন না) বোন পরতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। যখনই বোনের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, বিক্রির উদ্দেশ্যে কিছু শাড়িও নিয়ে আসতেন। দ্রুত সব শাড়ি বিক্রি হয়ে যেত। এরপর বেশি পরিমাণে শাড়ি নিয়ে এসে কোনো একটা গাছের নিচে মাদুর পেতে বিক্রি করতেন সেই তাঁতি। সেই শুরু। তাঁর দেখাদেখি অনেকেই তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে শাড়ি বিক্রি শুরু করেন।
এখানকার আরেক বিক্রেতা আবদুল ভাসানী জানালেন, দিনে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকার শাড়ি বিক্রি হয়ে থাকে। তবে উৎসবে বিক্রির পরিমাণ বেড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। ভ্যান ছাড়া বাড়তি কোনো খরচ না থাকায় খুব কম দামে এখানে শাড়ি বিক্রি করা যায়। যে কারণে এখানকার শাড়ি এত জনপ্রিয়। সাধারণত ৪৫০ টাকা থেকে শুরু হয় দাম। সর্বোচ্চ দাম হাজার–বারো শ টাকা। চাইলে দরদামও করতে পারেন। তবে যেই দামে তাঁরা শাড়ি বিক্রি করেন, একই শাড়ি ঢাকায় বিক্রি হয় দ্বিগুণ দামে। চাইলে পছন্দমতো নকশার শাড়ি এখান থেকে তৈরি করিয়েও নিতে পারবেন।