৮৬ বছর ধরে যে বেকারিটি ঢাকাবাসীর কাছে প্রিয়
পুরান ঢাকায় সরু গলি ধরে হাঁটতে হাঁটতে বেশ তৃষ্ণা পেল। জনসন রোডের এক দোকানে লেবু–পানিতে গলা ভেজানোর সময় চোখে পড়ল ছোট্ট দোকানটি। দেখে মনে হবে সাধারণ কোনো খাবারের দোকান, তবে মানুষের অহরহ আনাগোনা বেশ নজর কাড়ে। দোকানটির নাম ‘ইউসুফ কনফেকশনারী’ হলেও ‘ইউসুফ বেকারি’ নামেই বেশি পরিচিত। পুরান ঢাকার জনসন রোডের এই ইউসুফ বেকারির নাম বহুবার শুনলেও ঢুঁ মারার সুযোগ হয়নি। তাই যখন চোখের সমানে ঐতিহ্যের সঙ্গে উদরপূর্তির এমন দারুণ মানিকজোড় পেয়ে গেলাম, তখন ভেতরে পা না রাখলে কী হয়!
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৯ দশক আগে গোয়ালঘাট এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউসুফের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় ইউসুফ বেকারির। তাঁর নানা আবদুল ব্যাপারীর কেক-বিস্কুটের ব্যবসা ছিল। ফলে অল্প সময়েই বেকারি ব্যবসায় বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন মোহাম্মদ ইউসুফ। তাই তরুণ বয়সেই নিজের নামে খুলে ফেলেন দোকান। ১৯৩৯ সালে পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজারে ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টের পাশে শুরু হয় ইউসুফ বেকারির কার্যক্রম। সে সময় পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার, বংশাল, জনসন রোড ও আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যবসায়িক প্রয়োজন ও কোর্ট-কাছারির কাজে বহু মানুষ আসতেন। ধীরে ধীরে ক্রেতার সংখ্যা বাড়তে থাকে, সঙ্গে বেকারি পণ্যের পরিমাণও বাড়তে থাকে ইউসুফ বেকারিতে। ১৯৫৮ সালে বেকারিটির স্থান পরিবর্তন হয়, চলে যায় ১৯/এ জনসন রোডে। বেকারি পণ্য ছাড়াও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নানা ধরনের নতুন খাবার সংযোজন হতে থাকে বেকারিটিতে। তখন থেকেই এর নাম পাল্টে রাখা হয় ইউসুফ কনফেকশনারী।
দোকানে ঢুকতেই পাশের দেয়ালে চোখে পড়বে স্টিলের ফ্রেমে বাঁধানো এক বৃদ্ধের সাদাকালো ছবি। ইনিই বেকারির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ। বেকারিতে দেখলাম একদিকে কাচের তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ফাস্ট ফুডের খাবারদাবার, অন্যদিকে বেকারি আইটেম। ছোট্ট দোকানটি খাবারদাবারের এত পদ দিয়ে ঠাসা যে দেখে বেশ অবাকই লাগে। বাইরে থেকে দেখে কিন্তু তা বোঝা যায় না। ১৯৯০ সালে মারা যান মোহাম্মদ ইউসুফ। তাঁর ১১ ছেলে ও ২ মেয়ে। মোহাম্মদ ইউসুফের মৃত্যুর পর ছেলেরাই ব্যবসার হাল ধরেন। বর্তমানে পুরান ঢাকা, ধানমন্ডি, গুলশান, রমনা, রামপুরা, ধোলাইখালসহ মোট ১২টি শাখা পরিচালনা করছেন মোহাম্মদ ইউসুফের উত্তরসূরিরা।
ইউসুফ বেকারির সব শাখার খাবার তৈরি হয় একটি কারখানাতেই। আর সেটি পুরান ঢাকার জজকোর্টের পেছনে। জনসন রোডের মূল শাখা থেকেই ইউসুফ কনফেকশনারীর সব শাখায় খাবার সরবরাহ করা হয়। জনসন রোডের শাখার দেখাশোনা করেন ইউসুফের নাতি-নাতনি। তাঁরা হলেন মোহাম্মদ ইউসুফের ষষ্ঠ ছেলে মোহাম্মদ এয়াকুবের সন্তান ইশরাত জাহান ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ ইয়ামিন। তাঁরা জানান, খাবারের স্বাদ ও গুণগত মানে যেন কোনো পরিবর্তন না আসে, তাই সব খাবার একসঙ্গে তৈরি করে প্রয়োজনমতো প্রতিটি শাখায় সরবরাহ করা হয়। একই কারখানায় সব খাবার তৈরি করা হয় বলে ইউসুফ বেকারির সব শাখায় খাবারের মানও একই। স্বত্বাধিকারীদের কেউই তাঁদের দোকানের জন্য মোড়কজাত পণ্য বাদে ভিন্ন খাবার চাইলেও বানাতে পারবেন না।
হরেক রকমের খাবার
যথারীতি বিভিন্ন পদের বিস্কুট, পাউরুটি, নিমকি, কেক, চিপস মিলবে এখানে। দামও বেশ হাতের নাগালে। সঙ্গে মিলবে বাহারি ফাস্ট ফুড। প্যাটিস, বার্গার, রোল, ক্রিম বান, পরোটা, শিঙাড়াসহ অনেক ধরনের খাবার বানানো হয় এখানে। এ ছাড়া আর দশটা কনফেকশনারির মতো পানীয় এবং প্যাকেটজাত খাবারও বিক্রি হয়। তবে বিশেষভাবে দৃষ্টি কাড়ল সব উপকরণ মিশিয়ে তৎক্ষণাৎ বানিয়ে দেওয়া চানাচুর। এই চানাচুরের সব উপকরণ আলাদা আলাদা বয়ামে রাখা হয়। নিজেদের তৈরি টকডাল, মটরডাল, মোটা সেমাই, চিকন সেমাই, মুগডাল, বুন্দিয়া, চিড়া ভাজা, পাপড়, বেসনের গাঠিয়া, বাদামসহ মোট ১১টি পদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় মসলা মিশিয়ে বেশ মুখরোচক চানাচুর তৈরি করে দিলেন দোকানের কর্মী আকাশ। খেতেও বেশ সুস্বাদু। আকাশ জানান, চানাচুরের এসব উপকরণ তৈরির জন্য আলাদা একটি কারখানা আছে। কেউ চাইলেই নিজের মতো উপকরণ কম–বেশি যোগ করেও চানাচুর বানিয়ে নিতে পারবেন ইউসুফ বেকারি থেকে।
বিশেষ দিনে বিশেষ খাবার
ইউসুফ বেকারিতে শবে বরাত ও রমজান মাসে বিশেষ বিশেষ খাবার যোগ হয় বলে জানালেন আকাশ। অন্য সময় এসব পণ্য পাওয়া যায় না। যদিও ফরমাশ দিলে তাঁরা বানিয়ে দেন। শবে বরাতের সময় মাছ আকৃতির ফ্যান্সি রুটি বেশ জনপ্রিয় এখানে। মানুষ শখ করে দুই থেকে পাঁচ কেজি ওজনের এসব রুটি ফরমাশ দেন। সেই সঙ্গে সুজি ও বুটের হালুয়া তো থাকেই। রমজান মাসে ইফতার আইটেম হিসেবে সুতি কাবাব, জালি কাবাব, হালিম, কাটলেট, জিলাপি, নান, গ্রিলড চিকেনও পাওয়া যায়।
ইউসুফ বেকারির নিয়মিত ক্রেতা জিসান আলম। আরমানিটোলার এই বাসিন্দা জানান, বাসার জন্য সব বেকারি খাবার এখান থেকেই নেন। কেক নিতে এসেছিলেন সেদিন। সাবিহা নওরীন নামের আরেক ক্রেতা বলেন, এখানে ফাস্ট ফুডগুলোর স্বাদ তাঁর বাসার ছোটদের দারুণ পছন্দের, তাই সবকিছু এখান থেকেই নিয়ে যান।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউসুফ বেকারিতে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। প্রায় ৩০ মিনিট ছিলাম সেখানে। খেয়াল করলাম, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্রেতারা দোকানে কোনো কিছুর দাম আলাদা করে জানতে না চেয়ে পছন্দের আইটেম তুলে নিয়ে দাম মিটিয়ে চলে গেলেন। বুঝলাম, ইউসুফ বেকারির সঙ্গে তাঁদের জানাশোনা বহুদিনের।
খাবারের দরদাম
ইউসুফ বেকারিতে মুড়ি বিস্কুট, চিড়া বিস্কুট, মিষ্টি বিস্কুট, সলটেড, ড্রাই কেকসহ বেশ কয়েক রকমের বিস্কুট মিলবে। দাম কেজিপ্রতি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। চানাচুরের দাম পড়বে প্রতি কেজি ৩০০ টাকা। এখানে পাওয়া যায় কয়েক ধরনের প্যাটিস। প্রথম দেখায় একটি প্যাটিসকে কাপ কেক মনে হতে পারে। কিন্তু আদতে ‘কাপ প্যাটিস’ নামেই বিক্রি হয়। যার দাম ৫০ টাকা। এর বাইরে রোল প্যাটিস, মাটন প্যাটিস আছে। দাম পড়বে যথাক্রমে ৬০ ও ৪০ টাকা। এখানে দেখলাম বেশির ভাগ মানুষ কেক কিনতেই আসছেন। চকলেট, ফ্রুট, ওভালটিন, প্লেইন কেক, জ্যাম রোলের বেশ কদর। দাম পাউন্ডপ্রতি ১৯০ থেকে ৩০০ টাকা। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী টানা পরোটা বেশ প্রসিদ্ধ এখানে, দাম পড়বে প্রতি পিস ৩৫ টাকা। ৩০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে চিকেন চিপস আর ২০ টাকায় আলু চিপস। পাউরুটির দাম শুরু ৬০ টাকা থেকে। এখানকার ‘ঘোড়ার ডিম’ নামের ক্যান্ডির মতো এক খাবারের বেশ সুখ্যাতি। প্রতি প্যাকেটের দাম ৩০ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খাবারগুলো কেজিপ্রতি অর্ডার নেওয়া হয়। যেখানে পাইকারি ও খুচরা দামে কিছুটা ভিন্নতা থাকতে পারে।
বহুদিন ধরে খাবারের তালিকা ও মান একই রকম থাকে ইউসুফ বেকারিতে। প্রায় প্রতিটি আইটেম দিনে দিনেই শেষ হয় যায় বলে জানালেন ইশরাত জাহান। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে আসেন খাবারের স্বাদ নিতে। আর এভাবেই দীর্ঘ ৯ দশক ইউসুফ কনফেকশনারী বা ইউসুফ বেকারি পুরান ঢাকাবাসীর মনে যে জায়গা দখল করে নিয়েছে, তা দোকানে ভিড় দেখলেই উপলব্ধি করা যায়। এদিকে পুরান ঢাকায় গিয়ে আমিও বিনা পরিকল্পনায় ইউসুফ বেকারিতে আধা ঘণ্টা কাটিয়ে এলাম। ফাস্ট ফুড–প্রেমিক না হয়েও তিন-চার পদের খাবার দিয়ে উদরপূর্তি করে দিন শেষে বাড়ি ফিরলাম সেই মুখরোচক চানাচুর আর ঘোড়ার ডিমের প্যাকেট নিয়ে।